ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

ঠুঁটো জগন্নাথ প্রশাসন

শফিক হাসান
🕐 ১০:৪৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৬, ২০১৯

দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা, দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের ভূমিকা যেন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’-র মতো।

এর মধ্য দিয়েই একটি প্রশ্ন জাগছে জোরেশোরে- কোন দিকে যাচ্ছে বিশ^বিদ্যালয়, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ কী! ইতিপূর্বে প্রতিবেশী দেশগুলোতে শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে পড়তে এলেও বর্তমানে সেই ধারা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক এক জরিপে বিশ^সেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও ঠাঁই হয়নি সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি)।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কৃষক-শ্রমিকের শ্রম-ঘামের পয়সায় পরিচালিত। এ জন্য সবাই চান, কষ্টের অর্থের যেন সুষ্ঠু ব্যবহার হয়। সন্তানরা যেন সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হয়ে বাবা-মায়ের গর্বের ধনে পরিণত হতে পারেন। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, এ অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন আজকের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান কতটা যুগোপযোগী, কর্মজীবনে এমন শিক্ষা কতটা কাজে আসছে এমন প্রশ্ন করা হচ্ছে। শিক্ষকরাও এই প্রশ্নের আওতার বাইরে নন। বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্যতম কাজ গবেষণা হলেও বর্তমানে কতজন শিক্ষক গবেষণায় মনোযোগ দিচ্ছেন, নতুন তথ্য বা তত্ত্ব আবিষ্কার করছেন সেই প্রশ্ন দীর্ঘদিনের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নতজানু নীতি এবং সুবিধাবাদী মনোভাবেই ধস নেমেছে শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষার মান ধরে রাখতে পারছে না শিক্ষাঙ্গনগুলো। এতে জাতি একদিকে মেধাশূন্য হচ্ছে, অন্যদিকে সামষ্টিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একধরনের নৈরাজ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামষ্টিক পরিস্থিতি, প্রশাসনের ব্যর্থতা, সরকারের আগ্রাসী মনোভাব- এসব বিষয়ে কথা বলেছেন লেখক-বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ। গতকাল বুধবার তিনি খোলা কাগজকে বলেন, রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়। ৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়সহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে ব্যবহার করার সদিচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলোর নেই। এই না থাকার কারণ হলো- তারা নিজেরা তাদের অবস্থান পাকা করার জন্য সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ফলে তারা ছাত্রদের স্বার্থ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ এবং সামগ্রিকভাবে উচ্চশিক্ষার মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সমালোচনা করে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে রাষ্ট্রপতি চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেন। নিয়োগ পাওয়ার পর উপাচার্যগণ সরকারি দলের ছাত্রনেতাদের বশ্যতা স্বীকার করেন। তাদের খুশি করে নিজের অবস্থান শক্ত রাখতে চান। তার ফলে তিনি সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেন। আজকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুর্দশা, যে অনাচার তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনই মূলত দায়ী। সেই সঙ্গে সরকারের দায় তো রয়েছেই। এসব কিছুর মূলে উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনই দায়ী। এই অবস্থাটার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী নষ্ট রাজনীতি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের সমালোচনা করে খ্যাতনামা এ সাংবাদিক ও কলামিস্ট বলেন, কাগজে-কলমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন থাকলেও সরকার সেই স্বায়ত্তশাসন মেনে নিতে পারছে না। তারা নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। খুব শক্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উপাচার্য ছাড়া সরকারের চাপ উপেক্ষা করা চাকরি রক্ষাকারী কোনো শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উপাচার্য এবং সরকারপন্থি শিক্ষকরা জিম্মি করে ফেলেন। তার ফলে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম এবং প্রশাসন দুই-ই সরকারের আজ্ঞাবাহকে পরিণত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন মেরুদ-হীনতা সম্প্রতি নতুন করে আবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী। এই হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দিগম্বর ভাবমূর্তি’। উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনায় না রেখে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনকেই ‘উপদেষ্টা’ করে রাখেন সেটাও প্রমাণিত হয়েছে নতুন করে। নৃশংসতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় একবুক স্বপ্ন নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে বুয়েটে পড়তে আসা আবরার ফাহাদকে।

আবরার হত্যা নতুন করে প্রমাণ করে দিল ভাষা-আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্ররা যে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন সেসব এখন কেবলই স্মৃতি। গত দুই দশকে ছাত্রলীগ, ছাত্রদলের মতো ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলো সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, টেন্ডারবাজিতে এমনভাবে জড়িয়েছে তাতে সংগঠনের নামের আগে যে ‘ছাত্র’ শব্দটা আছে, এ শব্দের দায়িত্ব কী সেটাই ভুলতে বসেছেন তারা। ‘সরকারি টিকিট’ নামক যে সোনার হরিণ তারা পেয়েছেন, এই হরিণকে পেলে-পুষে বড় করার দিকেই সর্বোচ্চ মনোযোগ দিচ্ছেন তারা। তাদের যাবতীয় অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আজকের বুয়েটে যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটার সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড় কোনো তফাত নেই।

বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম দেশের সব ভিসির ‘প্রতিনিধিত্ব’ করে জানিয়ে দিলেন- আমরা এমনই, এটাই আমাদের কর্মপদ্ধতি! আবরার হত্যার ঘটনা জানাজানির পর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তারা বুয়েটের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দাবি করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে গড়িমসি করে। শিক্ষার্থীরা অনড় থাকলে একপর্যায়ে বিষয়টি গড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত।

শুধু বুয়েট ভিসিই নন, সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদাধিকারী নানাভাবেই নিজের পদকে অসম্মানিত করেছেন। কোটা আন্দোলনে ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এরপর তিনি ১০ টাকায় চা শিঙ্গাড়া সমুচা বিক্রির কথা বলে হাস্যরসের জন্ম দিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ছাত্রলীগের ৩৪ জন কর্মীকে চিরকুটের মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন ‘চিরকুট ভিসি’ হিসেবে। সর্বশেষ অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে ফার্নিচার ক্রয় দেখানো হয়েছে। জাবি উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা তছরুপ করার বিষয়ে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে কোটি টাকা চাঁদা দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসেন। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা দুর্নীতির অভিযোগে তার অপসারণ চেয়ে আন্দোলন করছেন।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ গালি দিয়ে জড়িয়েছেন অহেতুক বিতর্কে। শেষপর্যন্ত ছুটি নেওয়ার মাধ্যমে তার মেয়াদ শেষ হলে প্রতিষ্ঠান বর্তমানে চলছে ভিসি ছাড়াই! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নানা কেচ্ছাকাহিনীর জন্ম দিয়ে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। সাবেক কর্মস্থল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে চাইলেও শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পারেননি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বক্তৃতায় ‘জয় হিন্দ’সহ নিয়োগ বাণিজ্য করায় বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে আন্দোলন চলছে।

ত্রিশাল জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জন্ম দিয়েছেন নানা সমালোচনার। এভাবে প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একের পর এক সমালোচনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। সব জেনে-শুনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে পারছে না। আইনি বাধ্যবাধকতা ও নানা হিসাবনিকাশে সরকারও একধরনের নীরবতা পালন করছে। ফলে বাড়ছে সংঘাত, নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ।

 
Electronic Paper