মর্যাদা সংকটে বুয়েট
কুন্তল দে
🕐 ১০:৫০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৩, ২০১৯
দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগেরই স্বপ্ন থাকে বুয়েটে পড়ার। শিক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে কাঠখড় পুড়িয়ে সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রেখেই এ প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ মেলে। প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, দেশবাসীর কাছে তাই এক সম্ভ্রম, প্রত্যাশা আর মর্যাদার নাম প্রকৌশল বিদ্যার এই বিদ্যায়তনটি।
গবেষণা ও শিক্ষা- দুই ক্ষেত্রেই বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েটের নাম রয়েছে। সহপাঠীদের নির্মম পিটুনিতে আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনায় একে একে বেরিয়ে আসছে বুয়েটের মর্যাদার শক্ত ভিত্তির ভেতরে কীভাবে তিলে তিলে অনিয়ম, বেপরোয়াপনা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, অপসংস্কৃতির ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে। এক ঘটনাতেই কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা বুয়েটের মর্যাদার সোপানে লেগেছে তীব্র আঘাত।
বুয়েটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রাক্তনিরা মনে করছেন, আবরার হত্যার মধ্য দিয়ে বুয়েটের যে ভাবমূর্তির সংকট তৈরি হলো এর রেশ কাটতে দীর্ঘকাল কেটে যাবে। বুয়েটের এ অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে উপাচার্য, প্রশাসন, শিক্ষকদের সামনেই অধপতনের দিকে এগিয়েছে বুয়েট।
সবাই-ই স্রোতের দিকে গা-ভাসিয়ে দিয়ে নির্লিপ্ততার চূড়ান্ত পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ক্ষীণ প্রতিবাদ করেছেন। তবে গা জোয়ারি প্রবল স্রোতের তোড়ে সে প্রতিবাদ কারও কানেই ঢোকেনি।
তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশিত হলে শিউরে ওঠে সারা দেশের মানুষ। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সবখানে। জাতিসংঘের প্রতিনিধি, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এ হত্যার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দেন।
তদন্তে বেরিয়ে আসে, বুয়েট ছাত্রলীগের ১৯ নেতাকর্মী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা সেই কালো রাতের রোমহর্ষক ঘটনার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার আগে থেকেই টার্গেটে ছিলেন শেরেবাংলা হলের ছাত্রলীগ নেতাদের। ফেসবুকে বিভিন্ন সময়ে নানা ইস্যুতেই স্টাটাস দিতেন আবরার। রাজনৈতিকভাবে তিনি জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের কর্মী কি-না সেটা জানার জন্য তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে।
ছাত্রলীগের টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত কক্ষটিতে ৬ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয় তার ওপরে। ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প ও স্কিপিং রোপ দিয়ে পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চলে। একপর্যায়ে কয়েকবার বমি করে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আবরার।
আবরার হত্যাকা-ের পর বেরিয়ে আসে বুয়েটের হলগুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের পরিচয়ে কীভাবে একক দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী ছাত্রদের কাছে পুরো হলের শিক্ষার্থীরা ছিল বন্দি। প্রভোস্ট, আবাসিক শিক্ষক ও হল প্রশাসনের কর্মকর্তারাও তাদের স্বার্থে তোয়াজ করে চলতেন ছাত্র নেতাদের। হলে কে থাকবে, কে না থাকবে- সবকিছুই নির্ধারণ করে দিতেন দাপুটে এ সব নেতারা।
আবরার হত্যার পর বুয়েট ছাত্রলীগের একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের কথোপকথন ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, আবরারকে মেরে হল থেকে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিলেন হত্যার সঙ্গে জড়িতরা। ফলে ছাত্রলীগ নেতাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেই ছিল বুয়েটের হলগুলোর আইন-কানুন।
র্যাগের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে মারধর ও হল থেকে বের করে দেওয়া- এ সব কিছু গত কয়েক বছরে বুয়েটে সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছিল। আবরার হত্যার পর মুখ খোলেন বুয়েটের অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
তারা জানান, অভিযোগ জানিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি। তাই মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়েছে অমানবিক সব নির্যাতন। কারও হাত ভেঙেছে, কারও কানের পর্দা ফেটে গেছে, কেউবা আবার হারিয়েছেন মানসিক ভারসাম্য। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে আবার বুয়েটে পড়ার সাধ সাঙ্গ করে ভর্তি হয়েছেন অন্য কোথাও।
সবার চোখের সামনেই বুয়েটে এই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও র্যাগিংয়ের মতো অপসংস্কৃতি চালু হয়েছিল। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো বুয়েটেও নব্বই পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তিপ্রধান ছাত্ররাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে। দখলদারিত্ব, সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, একক আধিপত্য গত কয়েক দশকে ছাত্ররাজনীতির মূল প্রবণতা। এর বাইরে বুয়েট নয়। জানা গেছে, ২০১৪ সালের পর সেখানে ছাত্রলীগ ছাড়া আর কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই।
সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির চর্চার পরিবর্তে শুধু ক্ষমতা চর্চার রাজনীতি থাকার কারণে সেখানকার ছাত্রলীগে আদর্শিক থেকে সুবিধাবাদীরা গেড়ে বসেছিল। ফলে ছাত্রকল্যাণের বদলে স্বেচ্ছাচারী ও নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। নিজেদের দখল করা কক্ষগুলো তারা বানিয়ে ফেলেছিলেন টর্চার সেল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে করা হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। অথচ হল প্রশাসন এগুলো দেখেও না দেখার ভান করত।
গোটা বুয়েটেই জেঁকে বসেছিল র্যাগিংয়ের নামে ভয়ংকর নির্যাতন। বুয়েটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে র্যাগিং সংস্কৃতিটা দেশের সবচেয়ে মেধাবীরাই অনুশীলন করে এসেছে। এটাকে তারা ‘মজা’, ‘আদবকায়দা শেখানো’, ‘বাস্তব পৃথিবীর জন্য তৈরি করা’ ও ‘সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কোন্নয়ন’ ইত্যাদি নামে প্রচার করে।
এসবের নামে নবীন শিক্ষার্থীদের জোর করে সব রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের পরিচয় মুখস্থ রাখা, পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যদের জড়িয়ে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার, সবার সামনে পুরোপুরি নগ্ন করে নাচানো, সবার সামনে চরম অশ্লীল বই পড়তে বাধ্য করা, সবার সামনে যৌন অভিনয়ে বাধ্য করা, পেস্ট খেতে বাধ্য করা, সবার সামনে পর্নো দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা, রাতে মশার কামড় খাওয়ানোর জন্য বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে ওঠবস, বুকডন, মুরগি হয়ে বসিয়ে রাখা, প্রকাশ্যে কোনো মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বাধ্য করা, শীতের মধ্যে পানিতে নামানো ও ফুটবল খেলতে বাধ্য করা, শীতের রাতে সিনিয়রদের কাজে বাইরে পাঠানো, সিগারেট-গাঁজা-মদপানে বাধ্য করা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে রুম-মাঠের মাপ নেওয়া থেকে মারপিটের ঘটনা সবকিছুই ঘটত র্যাগিংয়ের নামে।
আবরার হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। দিনের পর দিন অপমান ও নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা দাবি তোলেন বুয়েটে র্যাগিং ও ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষক সমিতিও দাবি জানায় শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের। সবার দাবির মুখে উপাচার্য বুয়েটে সাংগঠনিক রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দেন। হলে হলে অভিযান চালিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের দখলে থাকা কক্ষগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। বুয়েট উপাচার্য শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মানলেও তারা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। প্রশাসন কি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঠিকঠাক আচরণ করবে, নাকি কিছুদিন কেটে গেলে আবার সব আগের নিয়মেই চলতে থাকবে- এ প্রশ্ন এখন তাদের।
বুয়েটের প্রাক্তনিরা মনে করেন, মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির সম্ভ্রম হারানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ দায়টা উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলে এতটা অধপতনে যেত না বুয়েট। আবরার হত্যার মতো বেদনাজাগানিয়া ঘটনা ঘটত না। আবরার হত্যার প্রতিবাদ ও প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পুনর্নির্মাণে মাঠে নেমেছেন তারা। প্রতিবাদে হয়েছেন শামিল।
বুয়েট অ্যালামনাই এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘অ্যালামনাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দীর্ঘদিনের নির্লিপ্ততা, অব্যবস্থাপনা ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থতার ফল। অতীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রমের তদন্ত, বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে উপাচার্যসহ বুয়েট প্রশাসনের ধারাবাহিক অবহেলা ও ব্যর্থতা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে মদদ জুগিয়েছে।’ বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অভিনেতা আবুল হায়াতের অভিমত, প্রশাসনকে আগে ধুয়ে-মুছে সাফ করতে হবে। হারপিক বা এর চেয়েও কড়া কিছু থাকলে তাদের পরিষ্কার করতে হবে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রাক্তনিরা সবারই ক্ষোভ উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের দিকে। আবাসিক হলগুলোতে দিনের পর দিন র্যাগিং এবং বিভিন্ন ঠুনকো অজুহাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হলেও এসব বন্ধে উপাচার্য কোনো পদক্ষেপ নেননি। আবরার হত্যার ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও তিনি ক্যাম্পাসে আসেননি। জানাজায়ও অংশ নেননি। পরে সমালোচনার মুখে আবরারের গ্রামের বাড়ি গেলে এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। তার এ আচরণের ব্যাখ্যা দাবি করেছিলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক সমিতি আর বুয়েট অ্যালামনাই পদত্যাগ চেয়েছে উপাচার্য সাইফুলের।
বুয়েটের উপাচার্য হিসেবে অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম যোগ দেন ২০১৬ সালের জুনে। প্রশাসক হিসেবে তার যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তার জন্য বাংলো থাকলেও তিনি থাকেন লালবাগ এলাকায়। বুয়েটে অফিস সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত হলেও তিনি অফিসে আসেন ১২টার পর। রাতেও অফিস করেন। উপাচার্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২২ বার তিনি বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।