বুয়েটে রাজনীতি বন্ধ
অপসংস্কৃতির কী হবে
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৩, ২০১৯
আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের দাবি ও আন্দোলনের মুখে বুয়েটে গত শুক্রবার থেকে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণার দুদিন আগে আন্দোলন চলাকালেই বুয়েটের শিক্ষক সমিতির নেতারা জরুরি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন যে, তারাও আর রাজনীতিতে জড়াবেন না। দেশের অন্যতম সেরা এই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ হলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যে অপসংস্কৃতি বিগত দিনে ক্যাম্পাসে গড়ে উঠেছে তা কিভাবে বন্ধ হবে, তা নিয়ে এখন নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেননা এই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির কারণে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকে পড়ালেখা বাদ দিয়ে বুয়েট ত্যাগ করেছে। নতুন যারা বুয়েটে ভর্তি হবেন তারা ভাবছেন বুয়েটে সুযোগ পেলেও ভর্তি হবেন কিনা। আর তাদের অভিভাবকরাও চিন্তিত সুযোগ পেলেও সন্তানকে বুয়েটে ভর্তি করাবেন কিনা।
এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুয়েটে যে অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে প্রশাসন কঠোর হলেই তা বন্ধ করা সম্ভব। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আগে থেকে পদক্ষেপ নিলে এমনটা হতো না। আবরারকে জীবন দিতে হতো না। তারা বলছেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা কমিটি আছে। বুয়েটেও আছে। শৃঙ্খলা কমিটি ভালোভাবে নজরদারি করলে ছাত্ররা র্যাগিংয়ের নামে বেপরোয়া আচরণ করতে পারে না।
এসব দেখাশোনার দায়িত্বে যেসব শিক্ষক থাকেন তারা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্টের লোভে দায়িত্ব পালনে শৈথিল্যতা দেখান। আর এর সুযোগ নেয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা। তা ছাড়া ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লোভে অনেক সময় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন শিক্ষকরা। যে কারণে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা কোনো অপকর্ম করলেও রেহাই পেয়ে যান। যে কারণে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা ক্যাম্পাসে সব সময় বেপরোয়া থাকেন। শিক্ষকরা ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করে কঠোর থাকলে এবং কাউকে প্রশ্রয় না দিলে শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে না।
সুপ্রিম কোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিংয়ের ঘটনা নিয়ে যদি আগে থেকে শিক্ষকরা ব্যবস্থা নিত তা হলে আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা ঘটত না।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, র্যাগিংয়ের নামে বুয়েটে নির্যাতন আর অপমানের ঘটনা ছিল হরহামেশাই। ভিন্ন মতের হলে শিবির অ্যাখ্যা দিয়ে নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে কখনো মুখ খুলতে চাইত না। মুখ বুঝে সব নির্যাতন সহ্য করত। নতুন করে নির্যাতনের শিকারের ভয়ে। এমন পরিস্থিতিতে নির্যাতনে শিকার হয়ে আবরার ফাহাদকে জীবন দিতে হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ একটি ওয়েবপেইজ খোলা হয়। পেজটিতে গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত র্যাগিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৬৬টি অভিযোগ জমা পড়েছে। ক্যাম্পাসে যে দীর্ঘদিন নির্যাতনের এমন ঘটনা ঘটত তা জমা পড়া এসব অভিযোগ থেকে স্পষ্ট ছিল। তারপরও কর্তৃপক্ষ এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নির্যাতনের শিকার বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিযোগ, গত ৩ ও ৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তার আগের দুই রাতে অর্থাৎ বুধবার এবং বৃহস্পতিবার র্যাগিংয়ের দিন ঠিক থাকে। নির্ধারিত কিছু কক্ষ ছাড়াও হলের ছাদগুলোতে চলে নির্যাতন।
নির্যাতনের জন্য ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প ব্যবহার হয় বেশি। বুয়েটের আহসান উল্লাহ হলের ২০১৬ ব্যাচের এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, প্রথম বর্ষে পড়ার সময় একদিন আমাকে ছাত্রলীগের কয়েকজন ছাদে নিয়ে ডেকে পাঠায়। হাফপ্যান্ট পরে হলে ঘুরলাম কেন, এটা নাকি আমার অপরাধ। সেদিন আমাকে মারধর ও চড়থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। এর পরের দিন আবার ডাকা হয়। সেদিন আমার অপরাধ ‘চুল বড় কেন’, অথচ আমার চুল ছোটই ছিল। আমাকে ওইদিন স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়েছিল তারা।
শেরেবাংলা হলের ২০১৮ ব্যাচের এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, তাকেও ডেকে নেওয়া হয়েছিল, আবরারকে যে রুমে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, সেই ২০১১ নম্বর কক্ষে। সেদিন ১০-১২ জনকে একসঙ্গে নিয়ে চড়-থাপ্পড় দিয়েছিল ছাত্রলীগের নেতারা। আবরার হত্যাকাণ্ডের আসামি অনিক সরকার সেদিনের নির্যাতনে নেতৃত্ব দিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আমাকে যখন চড়-থাপ্পড় দেওয়া হয়, এমনভাবে কথা বলছিল, যেন আমাকে আদর করছে। এক নাগাড়ে ২০-২৫টি থাপ্পড় দিয়েছিল। আবরারকে যখন ডাকা হয়, তখনো সবাই ভেবেছিল, র্যাগ দেওয়ার জন্য নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা এই পর্যায়ে পৌঁছবে কেউ ভাবেনি।
শিক্ষার্থীরা জানান, যখন কাউকে শিবির ব্লেইম দিয়ে নেওয়া হয়, তখন সে সিনিয়র হলেও জুনিয়র-সিনিয়র সবাই মারে। র্যাগের নামে এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে কান ফাটিয়ে দেওয়া হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে হল থেকে বহিষ্কার হন আহসান উল্লাহ হলের ছাত্রলীগ নেতা সৌমিত্র লাহিড়ী। কিন্তু দলীয় প্রভাবে তিনি হলেই ছিলেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। ওই হলের কেমিকৌশল বিভাগের এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, সৌমিত্র হলে বহাল তবিয়তেই ছিল। উল্টো তার উপকার হয়েছে, বহিষ্কারের সুযোগে হলের বিভিন্ন ফি দিতে হয়নি তাকে। র্যাগিংয়ের কারণে শাস্তির নজির একমাত্র সৌমিত্রই বলে জানান শিক্ষার্থীরা। এর বাইরে অনেক ঘটনা ঘটে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে তাদের অভিযোগ।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা তরুণরা সিনিয়রদের র্যাগিংয়ের শিকার হন। সিনিয়ররা নতুনদের কান ধরে ওঠবস করানো, রড দিয়ে পেটানো, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেয়ানো, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেওয়া, গাছে ওঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো, এমনকী দিগম্বর পর্যন্ত করে।
এ ছাড়াও গালিগালাজ করা, কুৎসা রটানো, নজরদারি করা ও নিয়মিত খবরদারির মতো নানা ধরনের মানসিক নির্যাতন করা হয়। তিনি এ বিষয়গুলো বন্ধে সরকারকে লিগ্যাল নোটিস পাঠিয়েছেন। ব্যবস্থা না নিলে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।