শিক্ষাঙ্গনে চলছে আন্দোলন
বুয়েট ভিসির পদত্যাগ দাবি ছাত্র-শিক্ষকের
শফিক হাসান
🕐 ১০:৩১ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৯, ২০১৯
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের পদত্যাগ দাবিতে একাট্টা হয়েছেন ছাত্র-শিক্ষকরা। ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরও এ ইস্যুতে সোচ্চার। আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তুলে ধরছেন ছাত্রলীগের নেতিবাচক দিকগুলো।
বুধবার (৯ অক্টোবর) আন্দোলনের তৃতীয় দিনে উপাচার্যের (ভিসি) পদত্যাগ দাবি করেছে বুয়েট শিক্ষক সমিতি। প্রতিষ্ঠানটির শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে আবরার হত্যার ঘটনায় ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ দাবি করা হয়। ধারাবাহিক আন্দোলনে গতকাল সকাল থেকে বুয়েটের শহীদ মিনার চত্বরে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি চলছিল। দুপুরে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে হাজির হন বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ। তিনি আন্দোলনকারীদের বলেন, ‘উপাচার্যের পদত্যাগের দাবির বিষয়ে শিক্ষক সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুয়েটে আগের বিভিন্ন ঘটনায় ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে আজকের এই অবস্থা হয়েছে। আমরা উনাকে এসব ঘটনার জন্য দায়ী করছি। উনাকে বুয়েট থেকে পদত্যাগ করতে হবে। উনি যদি পদত্যাগ না করেন, সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে উনাকে যেন অপসারণ করা হয়।’
শিক্ষক সমিতির সভাপতি আরও বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অপরাধের সঙ্গে রাজনীতির সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক সময় প্রশাসন অপরাধ বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে না। এমন নয় যে রাজনৈতিক দলগুলো কাউকে মারধর করতে বলে, নির্যাতন করতে বলে, কিন্তু সরাসরি রাজনীতির কারণে ক্যাম্পাসে পরিস্থিতি দিনে দিনে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নোংরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
বুয়েটে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অনেকাংশে দায়ী করে এ কে এম মাসুদ বলেন, ‘ক্ষমতা অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত, উপাচার্য একাই সব সিদ্ধান্ত নেন। বিভিন্ন সময়ে ওঠা নানা অভিযোগ নিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছে।’ এর আগে সকাল ১০টা ধেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত জরুরি সভায় বসে শিক্ষক সমিতি। সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ভিসিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন বুয়েটের ৩০০ জন শিক্ষক।
আবরার হত্যায় ব্যর্থতার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ পুরো প্রশাসনের অপসারণ চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন ছাত্রদের সমিতি। গতকাল সকালে বুয়েট খেলার মাঠে জরুরি বৈঠক থেকে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের জন্য সাত দফা দাবি জানায় বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর এক বিবৃতিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বুয়েট অ্যালামনাই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এই নির্মম হত্যকা- বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দীর্ঘদিনের নির্লিপ্ততা, অব্যবস্থাপনা ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থতার ফল। অতীতে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রমের তদন্ত, বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে উপাচার্যসহ বুয়েট প্রশাসনের ধারাবাহিক অবহেলা ও ব্যর্থতা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে মদদ জুগিয়েছে।’ বিবৃতিতে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ৭ দফা দাবি জানায়।
এদিকে শিবির সন্দেহে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মী কর্তৃক আবরার হত্যাকা-ের প্রতিবাদে আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করেছেন শেরেবাংলা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক জাফর ইকবাল খান।
একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের জের ধরে গত রোববার সন্ধ্যায় বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরারকে ডেকে নিয়ে যায় হলের কতিপয় ছাত্রলীগ নেতা। তারা নৃশংস কায়দায় আবরারের ওপর নির্যাতন চালান। নির্যাতনের একপর্যায়ে গভীর রাতে মৃত্যু হয় আবরারের। ঘটনাটি জানাজানির পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন সোমবার দিনভর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলনে উপাচার্য কিংবা হলের প্রভোস্ট ঘটনাস্থলে যাননি, খোঁজ নেননি আবরারেরও। সব মিলিয়ে ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলন পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে যায় দেশের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
গতকাল নতুন করে ১০ দফা দাবি দিয়েছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। দাবির মধ্যে রয়েছে-
১. খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুসারে শনাক্ত খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২. সিসিটিভি ফুটেজ থেকে জড়িতদের শনাক্ত করে শুক্রবার (আগামীকাল) বিকাল ৫টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করতে হবে।
৩. মামলার সব খরচ এবং আবরারের পরিবারের ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে। আগামীকাল বিকাল ৫টার মধ্যে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নোটিস জারি করতে হবে।
৪. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্বল্পতম সময়ে আবরার হত্যা মামলার নিষ্পত্তি করার জন্য বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের তথ্য দিতে হবে।
৫. আবরার হত্যা মামলার অভিযোগপত্রের কপি অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করতে হবে।
৬. বুয়েটে ‘সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি’ নিষিদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে বুয়েটে হলে হলে ‘ত্রাসের রাজনীতি’ কায়েম করে রাখা হয়েছে। জুনিয়র ব্যাচকে সবসময় ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে রাজনৈতিক মিছিল মিটিংয়ে যুক্ত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে কোনো সময় যে কোনো হল থেকে সাধারণ ছাত্রদের হল থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হলে হলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের এহেন কর্মকা-ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ক্ষুব্ধ। তাই ১৫ অক্টোবরের মধ্যে বুয়েটে সকল রাজনৈতিক সংগঠন এবং এর কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে যাননি এবং ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে কেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেছেন, কেন তিনি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেছেন, তাকে ক্যাম্পাসে এসে বুধবার (গতকাল) দুপুর ২টার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে।
৮. আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসানউল্লাহ হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে ১১ অক্টোবর (আগামীকাল) বিকাল ৫টার মধ্যে।
৯. আগে ঘটা এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরবর্তীকালে তথ্য প্রকাশের জন্য একটি কমন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কোনো ওয়েবসাইট বা ফর্ম থাকতে হবে এবং নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বুয়েটের বিআইআইএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে। ১১ অক্টোবর বিকাল ৫টার মধ্যে দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রদর্শন করতে হবে এবং পরবর্তী এক মাসের মধ্যে কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সব হলের প্রত্যেক ফ্লোরের সবগুলো উইংয়ের দুই পাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্র উৎখাতের ব্যাপারে নীরব থাকা এবং ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেরেবাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ অক্টোবর বিকাল ৫টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।
আবরারকে দাফন করা হয়েছে তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। দাফনের পর তার বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন বুয়েট ভিসি; কিন্তু কাছাকাছি গেলেও বাড়িতে ঢুকতে পারেননি তিনি। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী বাধায় তাকে চলে আসতে হয়েছে। তিনি শুধু আবরারের কবর জিয়ারত করতে পেরেছেন। এ সময় এলাকায় পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ শুরু। পুলিশ স্থানীয় হাজার হাজার জনতার বিক্ষোভে বাধা দিলে এ সংঘর্ষ বাধে। এ সময় পুলিশ লাঞ্ছিত করে নিহতের ছোটভাই আবরার ফায়াজকেও।
এর আগে গত মঙ্গলবার আবরার হত্যার দুদিন পর সন্ধ্যা ৬টার পরে ক্যাম্পাসে এসে আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়েন ভিসি। এ সময় শিক্ষার্থীরা জানতে চান, দুদিন ধরে তিনি কোথায় ছিলেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘আবরারের মৃত্যু হয়েছে।’
উপাচার্যের এমন মন্তব্যে শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা আবরারের মৃত্যু নয় তাকে খুন করা হয়েছে বলে চিৎকার শুরু করলে উপাচার্য বলেন, ‘ঠিক আছে খুনই হয়েছে। ঘটনার পর থেকে আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। পাঁচ থেকে ছয়জনকে নিয়ে বসেছি। সব তো আমার হাতে নেই, যেগুলো আমার হাতে আছে সেগুলো করছি। নীতিগতভাবে তোমাদের পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। সারা দিন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তোমরা অধৈর্য হবে না।’
শিক্ষার্থীরা তাদের দাবির বিষয়ে সিদ্ধান্ত না দিয়ে উপাচার্যকে ক্যাম্পাস না ছাড়ার দাবি জানান। অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।’ এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেন।
আবরারকে কতটা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখলে বিচার পাবেন বলে গতকাল আশা প্রকাশ করেছেন নিহতের বাবা বরকতুল্লাহ। বেলা সাড়ে ১২টায় কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠান শেষে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পিতা-মাতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। উনি তো এই জ্বালা জানেন। আমার সন্তানকেও নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। সন্তানকে যেভাবে মারেচে দেখলি পারে, উনি (প্রধানমন্ত্রী) যদি নিজে দেখেন তাহলে উনি নিজেই বিচার করবেন।’
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যতটুকু দেখছি, তাতে আমি খুশি। আরও চাই, যাতে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত হয়।’ সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বরকতুল্লাহ জানান, বুয়েট প্রশাসন থেকে এখনো কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘অমিত সাহার কক্ষে আমার ছেলেকে নির্যাতন করা হয়েছে। তার নামটা এজাহারে আসেনি। গতকাল (মঙ্গলবার) মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তাকে বলেছি অমিত সাহাকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উনি বলেছেন, তদন্ত করে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’