আবরার হত্যায় কাঁদছে দেশ
উত্তাল শিক্ষাঙ্গন
শফিক হাসান
🕐 ১১:১৩ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৮, ২০১৯
অভূতপূর্ব গণজাগরণে ফুঁসে উঠেছে দেশ; টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ধ্বনিত হচ্ছে অভিন্ন আওয়াজ- ‘আবরার হত্যার বিচার চাই।’ একটি মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে পুরো দেশকে; পুত্রশোকে কুষ্টিয়া নিবাসী বাবা-মা, স্বজন-প্রতিবেশীরাই শুধু কাঁদেননি, কেঁদেছে পুরো বাংলাদেশ। সরব ও নীরব রোদনে ভারী হয়ে আছে আকাশ-বাতাস। শোক ও ক্ষোভের সম্মিলনে স্ফুলিঙ্গ দাবদাহ হয়ে জ্বলছে দেশবাসীর বুকে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে শিবির সন্দেহে গত রোববার গভীর রাতে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের রোষানলে পড়েন আবরার।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাত চুক্তি ও তিন প্রকল্প স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে ছিল ফেনী নদীর পানি ভারতকে দেওয়ার বিষয়ও। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ার বিপরীতে প্রতিবেশী দেশকে উল্টো পানি দেওয়ার সিদ্ধান্তসহ সার্বিক বিষয়ে ইঙ্গিত করেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন আবরার।
এ স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার রাতে তাকে পিটিয়ে আহত করে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। নৃশংসভাবে পেটানোর পর একপর্যায়ে আবরার মারা যান। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা লাশ ফেলে যায় সিঁড়িতে। হত্যার বিষয়টি জানাজানি হলে আন্দোলনে নামেন বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা।
বুয়েট-ঢাবি থেকে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, বিক্ষোভে নামেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সব শ্রেণির মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার এই ইস্যুতে সরব ছিল পুরো দেশ। শোকে মুহ্যমান হয়েও হত্যার বিচার দাবির পাশাপাশি ছাত্রলীগের অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধের দাবি জানান তারা। তবে মঙ্গলবার নোয়াখালীর টাউন হলের মোড়ে বিক্ষুব্ধ জনতা মানববন্ধন করতে চাইলে পুলিশের বাধায় তা সম্ভব হয়নি।
আবরার হত্যা মামলায় জনসাধারণের চাওয়ার বিপরীতে আওয়ামী লীগ শীর্ষনেতারা মন্তব্য করেছেন, ছাত্রলীগের অনেক ভালো কাজও রয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা এ ইস্যুতে সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
হত্যা মামলার গ্রেফতারকৃত ১০ আসামিকে পাঁচদিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। চকবাজার থানায় আবরারের বাবার করা মামলায় গ্রেফতারকৃতদের গতকাল আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। শুনানি নিয়ে ঢাকার মহানগর হাকিম সাদবির ইয়াছির আহসান চৌধুরী পাঁচদিন রিমান্ডের আদেশ দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন।
পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয়েছে- বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, দ্বিতীয় বর্ষ), সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, দ্বিতীয় বর্ষ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, চতুর্থ বর্ষ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, চতুর্থ বর্ষ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, চতুর্থ বর্ষ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়ো মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, তৃতীয় বর্ষ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ), মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ (ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, তৃতীয় বর্ষ), মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির ও একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না।
চকবাজার থানার পরিদর্শক কবির হোসেন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন রিমান্ডের আবেদন করেছিলাম। পাঁচদিন মঞ্জুর করা হয়েছে। চকবাজার থানা পুলিশের কাছ থেকে মঙ্গলবার মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ গত সোমবার চকবাজার থানায় এই দশজনসহ মোট ১৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। এই হত্যাকাণ্ডের পর গত সোমবার রাতে ১১ জনকে স্থায়ীভাবে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
আবরারকে হত্যার ঘটনায় গতকাল আরও তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ। গ্রেফতারকৃত শামসুল আরেফিন রাফাত (২১) বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর ঝিগাতলা এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। অন্য দুজন হলো মনিরুজ্জামান মনির (২১), আকাশ হোসেন (২১)।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, এই তিনজন আবরারের বাবার করা মামলার এজাহারনামীয় আসামি। মঙ্গলবার বিকেলে ডেমরা থেকে মনিরকে এবং আকাশকে গ্রেফতার করা হয় সন্ধ্যায় গাজীপুর বাইপাস সড়ক থেকে। এ নিয়ে আবরার হত্যার ঘটনায় ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হলো।
আবরারকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল করা হয়েছে ঢাবি ক্যাম্পাসে। গতকাল দুপুরে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে গায়েবানা জানাজায় নেতৃত্ব দেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আকতার হোসেন। পরে প্রতীকী কফিন নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল মিছিল বুয়েটে যায়। ঢাবি ভিসি চত্বর, পলাশী হয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে সেই কফিন মিছিল। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর বকশিবাজার হয়ে আবার টিএসসির দিকে ফেরেন তারা।
গায়েবানা জানাজার পর ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তির বিরোধিতা করায় আবরারকে হত্যা করা হয়েছে। আবরারের রক্তস্নাত দেশবিরোধী চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।’ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর কফিন মিছিল থেকে ‘ভারতের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল কর, করতে হবে’, ‘আবরারের খুনিদের, ফাঁসি চাই দিতে হবে’, ‘ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘ছাত্রলীগের গু-ারা, হুঁশিয়ার-সাবধান’, ‘বুয়েট তোমার ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আবরারের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী ইউনিয়নের রায়ডাঙ্গা গ্রামের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানে তৃতীয় জানাজা হয়। কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তাকে দাফন করা হয়।
হত্যা মামলার চার্জশিট না দেওয়া পর্যন্ত বুয়েটের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখার দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে মামলার সুষ্ঠু বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে এ দাবি জানান তারা। এর আগে দুপুরে চলতি বছরের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিতসহ ৯ দফা দাবি জানান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের অনুপস্থিতি আন্দোলনকারীসহ সবার মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভিসি অসুস্থ দাবি করলেও শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন তিনি সুস্থ। শেষপর্যন্ত ভিসি মঙ্গলবার বিকেলে ক্যাম্পাসে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের নিয়ে সাড়ে ৪টার দিকে বৈঠকে বসেন।
বৈঠক শেষে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হন বুয়েট ভিসি। তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হলেও সব ক্ষমতা নিজের হাতে নেই। শিক্ষার্থীদের তিনি বলেন, ‘আবরার হত্যায় জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে বহিষ্কার করা হবে। শিক্ষা-উপমন্ত্রীর সঙ্গে তোমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেছি। দাবিগুলোর সঙ্গে নীতিগতভাবে আমরা একমত। তবে আমার হাতে সব ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা অনুযায়ী দাবিগুলো মেনে নেব।’
এর আগে বিকেল ৫টার মধ্যে আলোচনায় না বসায় সাড়ে ৫টার দিকে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করা হয়। আধাঘণ্টা অবরুদ্ধ থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন তিনি। কার্যালয়ের তালা খুলে দেওয়া হয় এরপর। এ সময় হত্যার বিচারসহ ৮ দফা দাবি পূরণের কথা জানান শিক্ষার্থীরা।
তারও আগে বুয়েট শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করতে আসেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা অভিভাবক হিসেবে ব্যর্থ হয়েছি। শিক্ষকরা বলি, প্রশাসন বলি, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। এক ছাত্রকে এভাবে পিটিয়ে মারা হলো, আমাদেরও অনেকের এই বয়সী সন্তান আছে। নিজের সন্তানদের মতো করে বিষয়টিকে ফিল করছি।’
শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েছেন বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। এ সময় শিক্ষার্থীরা তাকে ‘ভুয়া, ভুয়া; পদত্যাগ, পদত্যাগ’ বলে স্লোগান দেন। হত্যার বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নবাণে তাকে জর্জরিত করেন শিক্ষার্থীরা। মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার মনে হয় না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। বুয়েটেও নিষিদ্ধ করা উচিত।’
ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন ঘোষণার দাবি জানিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালনের সময় এমন দাবি জানান তারা। রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আবদুল মজিদ অন্তর বলেন, যতদিন পর্যন্ত আমাদের ৫ দফা আদায় না হবে, আবরার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
বিচার চেয়ে একাই কর্মসূচিতে নেমেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র খালিদ সাইফুল্লাহ। কয়েকটি প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থান নেন খালিদ। তিনি বলেন, একজন ছাত্র হয়ে আরেকজন ছাত্রকে হত্যা করা কখনও কাম্য নয়। সে যদি শিবির বা জঙ্গি হয়েও থাকে, তাহলে তাকে প্রশাসনের হাতে তুলে দিন। আপনি তারই হলের একজন বড় ভাই হয়ে তাকে হত্যা করতে পারেন না।
আবরার হত্যা সংবাদ সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছেছে বহিবির্শ্বেও। ফেসবুকে নানাজন নানাভাবে শোক প্রকাশ করেছেন। ভারতের জয়দেবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তনুশ্রী রায় লেখেন- ‘...সামান্য ফেসবুক স্টাটাসের কারণে মানুষ খুন করে ফেলা হচ্ছে বাংলাদেশে। কীভাবে এমন একটা দেশে মানুষ বাস করে!’
ফেসবুকে রিমেম্বারিং করা হলো আবরার ফাহাদের ফেসবুক আইডি। মৃত্যুর দিনও স্বাভাবিক ছিল আবরারের অ্যাকাউন্ট। পরে কোনো এক সময় ফেসবুক তাকে রিমেম্বারিং করার মধ্য দিয়ে জানিয়ে দিল বিদায়ের খবর। সাধারণত কেউ মারা গেলে মৃতের আইডি মুছে না দিয়ে স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আইডিটি রিমেম্বারিং করে রাখে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
উত্তাল শিক্ষাঙ্গন
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল সারা দেশের শিক্ষাঙ্গন। বেশ কিছুদিন ধরে শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলেও আবরারকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি আট দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকাল ভর্তি ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। পাশ্ববর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল দিনভর ছিল বিক্ষোভ। আবরারের গায়েবানা জানাজাসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ন্যক্কারজনক এ ঘটনার বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন।
আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের ফাঁসিসহ আট দফা দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে বুয়েট ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আট দফা দাবি হলো?খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করতে হবে, আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে এবং ভিন্নমত দমানোর নামে নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে, ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পরও ভিসি কেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি, মঙ্গলবার বিকেল ৫টার মধ্যে ভিসিকে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে এর জবাব দিতে হবে, হত্যা মামলার খরচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে, এর আগের ঘটনাগুলোর বিচার করতে হবে, ১১ অক্টোবরের মধ্যে শেরেবাংলা হলের প্রভোস্টকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া, আগামী সাত দিনের মধ্যে বুয়েটে সব ছাত্র রাজনীতি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের ঘোষণা দেন তারা।
উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বিকেল সোয়া ৪টার পর ক্যাম্পাসে এলেও শহীদ মিনারে বিক্ষোভস্থলে না গিয়ে নিজের কার্যালয়ে চলে যান। এ প্রতিবেদন লেখার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে ভিসির অফিসের নিচে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। দিনভর এ বিক্ষোভে বুয়েটের শিক্ষকদের সমর্থন পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে শিক্ষক সমিতি।
পার্শ্ববর্তী বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দুপুরে রাজু ভাস্কর্য চত্বরে গায়েবানা জানাজায় নেতৃত্ব দেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আকতার হোসেন। পরে প্রতীকী কফিন নিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল মিছিল বুয়েটে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বর, পলাশী হয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে সেই কফিন মিছিল। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর বকশি বাজার হয়ে আবার টিএসসির দিকে ফেরেন তারা।
গায়েবানা জানাজার পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তির বিরোধিতা করায় আবরারকে হত্যা করা হয়েছে। আবরারের রক্তস্নাত দেশবিরোধী চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।’ বিকেল ৫টায় ঢাবি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এতে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা অংশ নেন। সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা।
এদিকে আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পার্শ্ববর্তী সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন তারা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। মানববন্ধন শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ দিদারের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, শিক্ষার্থী কাব্য কৃত্তিকা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (মার্কসবাদী) সভাপতি মাহাথির মোহাম্মদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সুস্মিতা মরিয়ম, জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান।
একইভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকেল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে মানববন্ধন করে। ‘হিউম্যান রাইটস’ নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। পরে সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি ফলকের সামনে গিয়ে শেষ হয়। এর আগে দুপুর সোয়া ২টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবরারকে পিটিয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরের পরিবেশ উন্মোচিত হয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নানা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যাওয়ায় তারাও ফুঁসে উঠেছেন। আবরারের হত্যকারীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হবে।
তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কর্তৃক শিক্ষার্থী নির্যাতনের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত হলে বুয়েটে আবরারকে জীবন দিতে হতো না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হত্যাকারী সৃষ্টির উপাদান বন্ধের পরামর্শ তাদের।
ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়ার জের ধরে আবরার ফাহাদকে রোববার (৬ অক্টোবর) রাতে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের নিচতলা ও দুইতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে রাজধানীর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯ জন ছাত্রলীগ নেতাকে আটক করেছে পুলিশ।
নিহত আবরার বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শাখা ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মীকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে সংগঠনটি। অভিযোগের সত্যতা উদ্ঘাটনে গঠিত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
চাপের মুখে দাবি মেনে নিলেন ভিসি
বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সব দাবির সঙ্গে সহমত জানিয়ে চাপের মুখে দাবিগুলো মেনে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।
গতকাল মঙ্গলবার বিকালে নিজ কার্যালয়ে প্রোভোস্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠক শেষে তিনি শিক্ষার্থীদের সামনে আসেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের সব দাবির সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে ভিসি বলেন, তোমরা যে দাবিগুলো করেছ, আমি সেই দাবিগুলো মেনে নিয়েছি। আমি তোমাদের দাবির সঙ্গে নীতিগত সমর্থন জানাচ্ছি। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। একপর্যায়ে ভিসিকে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করেন, আবরার হত্যার ঘটনার পর তিনি কেন ক্যাম্পাসে আসেননি? জবাবে ভিসি বলেন, আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ বলে স্লোগান দিতে শুরু করেন। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আবরার হত্যায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শনাক্ত হওয়া খুনিদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীবন বহিষ্কারসহ সাতদফা দাবি তুলে ধরেন তারা।
দাবিগুলো হলো-
১. খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা।
২. ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শনাক্ত হওয়া খুনিদের সবার ছাত্রত্ব আজীবনের জন্য বাতিল করা।
৩. আবরার হত্যায় দায়ের করা মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করা।
৪. আবরার হত্যার ৩০ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি, তা তাকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে জবাবদিহি করতে হবে। একই সঙ্গে ডিএসডব্লিউ কেন ঘটনাস্থল থেকে পালিয়েছেন, তাকে সবার সামনে এ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।
৫. আবাসিক হলগুলোতে র্যাগের নামে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসান উল্লাহ হল ও সোহরাওয়ার্দী হলের আগের ঘটনাগুলোতে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল নিশ্চিত করতে হবে।
৬. রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্র উৎখাতের ব্যাপারে অজ্ঞ থাকা ও ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শের-ই বাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ নভেম্বরের মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।
৭. মামলা চলাকালীন সব খরচ ও আবরারের পরিবারের সব ধরনের ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে।
ভিসি ড. সাইফুল ইসলাম আরও বলেন- আবরার হত্যায় জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে বহিষ্কার করা হবে। আমি শিক্ষা-উপমন্ত্রীর সঙ্গে তোমাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলেছি। তোমাদের দাবিগুলোর সঙ্গে নীতিগতভাবে আমরা একমত।
এর আগে, বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার একদিন পর মঙ্গলবার বিকাল ৫টার দিকে ক্যাম্পাসে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী, বিকাল ৫টার মধ্যে আলোচনায় না বসায় সাড়ে ৫টার দিকে তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। আধাঘণ্টা অবরুদ্ধ থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হন তিনি। এরপর তার কার্যালয়ের তালা খুলে দেয় আন্দোলনকারীরা। এ সময় আবরার হত্যার বিচারসহ সাতদফা দাবি পূরণের আহ্বান জানানো হয় শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে।
উল্লেখ্য, ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়ার জের ধরে আবরার ফাহাদকে গত রোববার রাতে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এরপর রাত ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের নিচতলা ও দোতলার সিঁড়ির করিডোর থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।