ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভিসির আয়নায় কার মুখ

মনোজ দে
🕐 ১০:৩৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুবিপ্রবি) দুর্নীতি, অনিয়ম, শিক্ষার্থী বহিষ্কারসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচনার ঝড় বইছে। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় তিনটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। ঢাবি ও জাবিতে দুর্নীতি ও জালিয়াতির বিরুদ্ধে আন্দোলনও হচ্ছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ারও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিন বিশ্ববিদ্যালয়েই এ সব দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে উপাচার্যদের (ভিসি) কর্মকা- ভূমিকা রেখেছে। তিন ভিসির বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে টাকা ভাগাভাগি, পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই ভর্তি জালিয়াতি ও ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জের ধরে শিক্ষার্থী বহিষ্কারের মতো স্বেচ্ছাচারী আচরণের সংবাদের জের ধরেই সংকটের মুখে পড়েছে তিন বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদরা এসব ঘটনাকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে উপাচার্যদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। এটা শুধু প্রশাসনিক পদ নয়। শিক্ষা কার্যক্রম থেকে শুরু করে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক জ্ঞানচর্চা, সাংস্কৃতিক আবহ কেমন হবে তা উপাচার্যের বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও গরিমার উপরেই নির্ভর করে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেই যখন দুর্নীতি, জালিয়াতি আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে তবে সেটা শুধু নৈতিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ নয়, পুরো দেশের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক। এমন নজির আগে কখনো ঘটেনি। আগে ব্যক্তি পর্যায়ে ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ এমন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কিংবা উপাচার্যের সঙ্গে যুক্ততার ঘটনা ঘটেনি। আবার বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সঙ্গে প্রশ্ন করা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা- এসব বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই ফেসবুকে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কি’ এমন কোনো প্রশ্ন করায় শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের মতো ঘটনা শিক্ষার জন্য অশনি সংকেত। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যায়তন এভাবে বিতর্কিত হতে থাকলে জাতির জন্য এটি খুব খারাপ ফলাফল বয়ে আনবে।

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান, জাবি ভিসি ফারজানা ইসলাম, বশেমুবিপ্রবি ভিসি অধ্যাপক খন্দকার মো. নাসিরউদ্দীনই নন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খুব কম উপাচার্যই বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন। শিক্ষকতা জীবনের সুনাম অর্জন করা শিক্ষকরাও উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার পর দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতি কিংবা ক্ষমতাসীন দলের অন্ধ লেজুড়বৃত্তি করতে দেখা গেছে। ফলে তার শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবনের অর্জিত জন্যও ভিসির চেয়ারে বসার পর ধূলিসাৎ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এতে প্রশ্ন উঠেছে নিয়োগ পাওয়ার পর ভিসিরা যে অচেনা আচরণ করেন এর পেছনে আসলে কারণ কি? নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিরা আয়নায় কার মুখ দেখেন?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সংকট তার পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি দায়ী। যেই দল ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যেন নিজেদের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন থাকে। মূলত পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনড় মনোভাবের কারণেই ক্ষমতাসীনরা চান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র সংসদ নিজেদের কব্জায় নিতে। দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় উপাচার্য থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত নিয়োগ হওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যাশা পূরণেই মনোযোগী থাকতে হয় তাদের। এর ফলেই প্রতিনিয়ত নানা বিতর্কের জন্ম দিচ্ছেন উপাচার্যরা। প্রশ্ন উঠছে তাদের সততা ও নৈতিকতা নিয়ে। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব ও উন্নয়ন দুই খাতেই বড় বরাদ্দ হচ্ছে। এ সব বরাদ্দ থেকে নানা নয়ছয়ের ঘটনা ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করে বলেছেন, ‘উন্নয়ন কাজের টাকায় ছাত্র রাজনীতিকরা ভাগ বসায়, এখান থেকে টাকা চায়, এটি অচিন্ত্যনীয়। অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এসব ঘটছে। হয়তো এগুলো গণমাধ্যমে আসে না। ভাগাভাগিগুলো এমনভাবে হচ্ছে যে তা গণমাধ্যমে আসছে না।’

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান গণমাধ্যমে বলেন, ‘অনেক সুবিধাভোগী মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বরাদ্দ থেকে নানা সুযোগ নিতে চায় ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমে। এটা সামাল দিতে গিয়ে উপাচার্যরা নানা ধরনের বিতর্কের জন্ম দিচ্ছেন।

উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ছাত্রলীগকে কোটি টাকা ভাগ
সম্প্রতি একনেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য পাস হয় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। প্রথম ধাপে বরাদ্দ হয় সাড়ে চারশ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের শুরু থেকেই প্রকৃতি ধ্বংস করে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একাংশ। আন্দোলন দমাতে ও উন্নয়ন প্রকল্পে যাতে বাধা সৃষ্টি না করা হয় এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন উপাচার্য ফারজানা ইসলাম। ওই বৈঠকে জাবির তিন নেতাকে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে এক কোটি টাকা ঈদ সেলামি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। জাবি ছাত্রলীগকে সেলামি দেওয়ার খবর শুনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদ্য অপসারিত সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী উপাচার্য ফারজানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ৪-৬ শতাংশ কমিশন বা ন্যায্য হিস্যা দাবি করেন। এ ঘটনায় শোভন-রাব্বানীকে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর পরপরই রাব্বানীর সঙ্গে জাবি ছাত্রলীগের এক নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়। যেখানে দাবি করা হয়, উপাচার্য জাবির তিন নেতাকে ঈদ সেলামি হিসাবে এক কোটি টাকা ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে উপাচার্যের স্বামী ও ছেলে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে।

এ দিকে উপাচার্য উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ছাত্রলীগকে টাকা ভাগ করে দিয়েছেন এমন খবর প্রকাশ হলে গত মাসের শেষদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর ব্যানারে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একাংশ। অডিও ফাঁস হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একাংশ উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি এসব অভিযোগের তদন্ত করছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে পদ থেকে অপসারণের পাশাপাশি শাস্তির মুখে পড়তে হবে তাকে।

পরীক্ষা ছাড়াই চিরকুটে ভর্তির অভিযোগ ঢাবিতে
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি হয়ে ডাকসু নেতা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রলীগের ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান নেতা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের মাস্টার অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হন। নির্বাচন করতে আগ্রহী এই ৩৪ জনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সম্পাদক ও সদস্য পদে নির্বাচনে আটজন অংশ নেন, বিজয়ী হন সাতজন। এ ছাড়া দুটি হল সংসদের ভিপি পদে অংশ নেন দুজন। এর মধ্যে একজন নির্বাচিত হন, অন্যজন পরাজিত হন। আরেকজন ছিলেন ছাত্রলীগের ডাকসু নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য। ভর্তির নীতিমালা অনুযায়ী, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল ওই প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়া যায়। কিন্তু তাদের কেউই তাতে অংশ নেননি।

ওই ছাত্রলীগ নেতারা উপাচার্যের কাছ থেকে চিরকুট নিয়ে মাস্টার অব ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগে আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল আন্দোলনকারীরা বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের কার্যালয় ঘেরাও করতে গেলে ছাত্রলীগ তাদের উপর চড়াও হয়।

সমালোচনামাত্রই বশেমুবিপ্রবি শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার
গোপালগঞ্জের বশেমুবিপ্রবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খন্দকার মো. নাসিরউদ্দীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থী বহিষ্কারের। মানববন্ধন, ফেসবুক স্ট্যাটাসের জের ধরে গত এক বছরে সেখানে ৩৪ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। সর্বশেষ আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জিনিয়াকে বহিষ্কার করলে ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় তার বিরুদ্ধে। গত ১০ আগস্ট জিনিয়া তার ফেসবুকে লেখেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ কী হওয়া উচিত’। এই স্ট্যাটাসে অনেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করেন, এটাকে ইস্যু বানায় কর্তৃপক্ষ। শাসনের নামে জিনিয়ার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও চরম অশোভন আচরণও করে উপাচার্য। এ নিয়ে একটি অডিও ভাইরাল হলে ফের সমালোচিত হন উপাচার্য নাসিরউদ্দিন। প্রশ্ন ওঠে তার স্বেচ্ছাচারী আচরণ নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক খোলা কাগজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরনের ঘটনা অপ্রত্যাশিত। সামান্য বিষয় নিয়ে কোনো শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার ও তার জীবনকে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

 
Electronic Paper