ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হালখাতা বদলানোর খেলা

রংপুর-৩ উপনির্বাচন

কুন্তল দে
🕐 ১০:২৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৯

রংপুর বিভাগের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসনের উপ-নির্বাচন আগামী ৫ অক্টোবর। রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় সাড়ে চার লাখ ভোটারের এ নির্বাচনী আসনটি ৩৩ বছর ধরে জাতীয় পার্টির (জাপা) দখলে। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বাড়ি এখানেই। এ আসন থেকে পাঁচবার নির্বাচন করে বিপুল ব্যবধানে জিতেছিলেন তিনি। ভাই জি এম কাদের ও স্ত্রী রওশন এরশাদও প্রতিপক্ষকে বিপুল ব্যবধানে হারিয়ে জিতেছেন দুবার। জাতীয় পার্টির ঘাঁটি বলে পরিচিত এ আসনটি এরশাদের পরিবারের নিজস্ব আসন।

রংপুরের ছওয়াল এরশাদের আসনটি শূন্য হয়েছে সম্প্রতি তার মৃত্যুর পর। কিন্তু এরশাদশূন্য বাস্তবতায় এ আসনের উপ-নির্বাচনের সমীকরণ কী হতে পারে তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১০ মাস পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ উপনির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি প্রধান তিন রাজনৈতিক দল নতুন করে নিজেদের রণনীতি সাজাচ্ছে। পুরনো সমীকরণ বাদ দিয়ে তিন দলই নতুন হিসাবের হালখাতা খুলতে চাই এ উপ-নির্বাচনে। শেষপর্যন্ত যেই জিতুক রংপুরের রাজনীতিতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তিন দলই আলাদা করে তাদের প্রার্থী দিয়েছে। আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম রাজু, জাতীয় পার্টির রাহগীর আল মাহি সাদ, বিএনপির রিটা রহমান এ আসনে প্রার্থী হয়েছেন। এর বাইরে এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার লাঙ্গল প্রতীক না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে লড়ছেন। মোট নয়জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিলেও সাতজনের মনোনয়নকে বৈধতা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

১৯৮৬ সাল থেকেই রংপুর সদর জাতীয় পার্টির কব্জায়। ওই বছরের নির্বাচনে শফিউল গনি স্বপন এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় সামরিক শাসক এরশাদের। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কারাগারে বসেই রংপুর সদরসহ ৫টি আসনে নির্বাচন করে সবকটিতেই জেতেন। এরপর ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ এর সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকেই জেতেন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে আইনগত বৈধতা না পাওয়ায় নির্বাচন করতে পারেননি এরশাদ। সেবার তার ভাই জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের ওই আসন থেকে নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি তিনি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে তার স্ত্রী রওশন এরশাদ এখান থেকে জিতে সংসদে যান।

এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ আসনের বহু ভাগিদার জুটে যায়। এ আসনে হিস্যা কোন পক্ষে যাবে এবং কেন্দ্রে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা কীভাবে হবে-এ নিয়ে দলের দুই প্রধান নেতা জি এম কাদের ও রওশন এরশাদ, যাদের ওপর এরশাদ জাতীয় পার্টির দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন, তারাই বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। ফলে ভাঙনের শঙ্কা দেখা দেয় দলে। এ অবস্থায় শীর্ষ কয়েকজন নেতার তৎপরতায় ক্ষমতার ভাগাভাগি হয় জাতীয় পার্টিতে। সমঝোতা হয় রংপুর-৩ আসন মানে এরশাদের আসনে জাতীয় পার্টির উত্তরসূরি কে হচ্ছেন। স্থানীয় জাপার প্রবল বিরোধিতা ও অসহযোগিতার হুমকির পরও রওশনপুত্র সাদকে জাপার প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়। রংপুর জাপার এই বিদ্রোহের কেন্দ্রে রয়েছেন রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। সাদকে প্রার্থী করা হলে তার সঙ্গে অসহযোগ আচরণ করা হবে ঘোষণা করেন মহানগর জাপার প্রতাপশালী এই নেতা। শেষ পর্যন্ত তাকে শান্ত না করতে পারলে জাতীয় পার্টির নিজস্ব এ আসনের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে-তা বলা মুশকিল। কেননা মেয়র মোস্তফা রংপুর জাপার কত বড় নিয়ামক নেতা তার প্রমাণ তিনি এরশাদের মৃত্যুর পরই দেখিয়ে দিয়েছেন। উত্তরাঞ্চলের লাখো নেতাকর্মীকে নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের বাধ্য করেছেন রংপুরে পল্লীনিবাসে এরশাদকে সমাহিত করতে।

কেন্দ্রের শীর্ষ দুই নেতার সমঝোতার ভিত্তিতেই রওশনপুত্র সাদ রংপুর সদরের উপনির্বাচনে জাপার প্রার্থী। এ সমঝোতার নেপথ্যের কুশীলব ছিলেন জাপা মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। লাঙ্গলের প্রার্থী হিসাবে সাদের মনোনয়নপত্র জমা ও নির্বাচনী কর্মকা- দেখভাল করছেন তিনি। কিন্তু এ আসনে সাদের সাফল্য নির্ভর করছে মেয়র মোস্তফার সঙ্গে কতটা সমঝোতা হচ্ছে, তার উপরেই।

লাঙ্গলের প্রার্থী না হতে পারলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার এই উপনির্বাচনে জয়-পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। রংপুরের সন্তান ও এরশাদের পরিবারের সদস্য- এ দুই সেন্টিমেন্ট তার দিকেই। আর মেয়র মোস্তফাসহ স্থানীয় নেতাদের সমর্থন পেলে তার জনসমর্থনের পাল্লা অনেক ঝুঁকে পড়বে তার দিকেই। এরই মধ্যে আসিফকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগ যাতে সেখানে প্রার্থী না দেয় এ রকম সমঝোতার চেষ্টাও করেছে কেন্দ্রীয় জাপা। তবে সেটা হালে পানি পায়নি। আগামী ৫ অক্টোবর রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির জন্য একেবারে নতুন সমীকরণ নিয়ে হাজির হচ্ছে। ৩৩ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম লাঙ্গল এ আসনে একটা অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়তে যাচ্ছে। নিজেদের গৃহবিবাদেই এ হাল জাপার। আর তাই এ উপনির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিকে হালখাতায় নতুন হিসাব খুলতে হতে পারে। এরশাদের জীবিত অবস্থাতাতেই রংপুরভিত্তিক দলের তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টি-তার মৃত্যু-পরবর্তীকালে নিজেদের দুর্গে কতটা শক্তি ধরে রাখতে পারছে তার প্রমাণ মিলবে এ নির্বাচনেই। জোটের বাইরে নির্বাচন হওয়ায় এককভাবে নিজেদের সক্ষমতা কেমন তারও প্রমাণ মিলবে।

১৯৭৩ সালের পর রংপুর সদর আসন আওয়ামী লীগ কখনো জেতেনি। ভোটের সমীকরণে এ আসনে দ্বিতীয় শক্তিশালী দল আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সাল থেকে এ আসনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করে নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ। তবে ২০১২ ও ২০১৭ সালে দুটি সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এর মধ্যে ২০১২ সালের সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। অবশ্য ৫ বছর পরের নির্বাচনে প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হারেন তিনি। ৫ অক্টোবর রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির রংপুর দুর্গে হানা দিতে চায়। এরশাদ-পরবর্তী জাতীয় পার্টির মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রংপুর বিভাগের সব আসনেই নিজেদের শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে মরিয়া আওয়ামী লীগ। সাদ-আসিফকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক জাপার যে বিভক্তি সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লাঙ্গলের মাটিতে জয় ছিনিয়ে আনতে চায় নৌকা। এ উপনির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের হালখাতায় রংপুর জয়ের হিসাব-নিকাশই লিখতে চায়।

রংপুর সদরে বিএনপির ভিত্তি আগাগোড়াই দুর্বল। এরপরও এ আসনে উপনির্বাচনে নিজেদের অবস্থা ঝালিয়ে দেখতে চায় বিএনপি। এ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী করা হয়েছে এনপিপি থেকে সদ্য বিএনপিতে যোগ দেওয়া রিটা রহমানকে। বিএনপির এই প্রার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা হত্যার পলাতক আসামি মেজর (অব.) খায়রুজ্জামানের স্ত্রী। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের দুই শরিক গণফ্রন্ট ও এনপিপি আলাদা প্রার্থী দিয়েছে নির্বাচনে। এ উপনির্বাচনের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে চায় বিএনপি। মাঠের রাজনীতিতে নিজেদের সক্রিয়তা ধরে রাখার পাশাপাশি ও সামর্থ্যর হিসাব হালখাতায় লিখতে চায়।

 

রংপুর উপ-নির্বাচন
সাতজনের মনোনয়ন বৈধ, বাতিল ২

রংপুর অফিস

জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ (সদর) আসনের উপ-নির্বাচনে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে। এতে নয়জনের মধ্যে সাতজনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর ঋণ খেলাপির অভিযোগে বাতিল হয়েছে দুজনের মনোনয়নপত্র। তার মধ্যে বিএনপির এক বিদ্রোহী প্রার্থীও আছেন।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) রংপুরের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার জিএম শাহাতাব উদ্দিন যাচাই-বাছাই শেষে এ ঘোষণা দেন।

যাদের প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে তারা হলেন-আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম রাজু, জাপার সাদ এরশাদ, বিএনপির রিটা রহমান, জাপার বিদ্রোহী প্রার্থী এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহারিয়ার, এনপিপির শফিউল আলম, গণফ্রন্টের কাজী শহিদুল্লা এবং খেলাফত মজলিসের তৌহিদুর রহমান রাজু।

প্রার্থিতা বাতিল হওয়া দুজন হলেন- বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা ও বাংলাদেশ কংগ্রেস দলের প্রার্থী একরামুল হক। ঋণ খেলাপির অভিযোগে তাদের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করা হয়।

জাপার প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের মৃত্যুতে রংপুর-৩ আসনটি শূন্য হয়। গত ১৪ জুলাই এরশাদ মারা যান। ১ সেপ্টেম্বর রংপুর-৩ আসনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

এ আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে আগামী ৫ অক্টোবর। মনোনয়নপত্র বাছাই ১১ সেপ্টেম্বর। আর প্রার্থিতা প্রত্যাহার ১৬ সেপ্টেম্বর। পুরো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএমে)।

 

 
Electronic Paper