ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ইজারার নামে হাওর দখল

হাইল হারাচ্ছে প্রাণপ্রাচুর্য

ছাইফুল ইসলাম মাছুম
🕐 ১০:২০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০১৯

ফিসারির নামে মৌলভীবাজারের হাইল হাওর দখল হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া চারপাশের চা ও লেবু বাগানে ব্যবহার করা কীটনাশকে মারা যাচ্ছে মাছসহ হাওরটির জলজ প্রাণী। এতে চরম হুমকির মুখে পড়েছে হাওরের জীববৈচিত্র্য। দিন দিন প্রাকৃতিক এই জলাভূমির চিত্র আরও খারাপ হচ্ছে। সজীবতা হারাচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ভূমি অফিসসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই দখল ও দূষণ চলছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে হাওরের জীববৈচিত্র্য একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, বন্ধ হয়ে যাবে হাওরকেন্দ্রিক কয়েক হাজার দরিদ্র মানুষের জীবন জীবিকা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান খোলা কাগজকে জানান, কখনো ইজারার নামে, কখনো প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতাশালীরা হাওর দখল করছেন। তিনি বলেন, হাওরের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার কথা ভেবে তথাকথিত লিজ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। তার পরামর্শ, জরিপ পরিচালনা করে পুরো হাওরের নকশা প্রণয়ন করতে হবে। হাইল হাওরের আয়তন অনেক বড় হওয়ায় কয়েকটি উপজেলার মধ্যে এর সীমানা রয়েছে। অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ও যুক্ত রয়েছে হাওরের সঙ্গে। ফলে এই হাওরকে বাঁচাতে হলে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় প্রয়োজন। হাইল হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারে অবস্থিত একটি বৃহৎ জলাভূমি।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, হাইল হাওর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত। এতে ১৪টি বিল এবং পানি নিষ্কাশনের ১৩টি নালা রয়েছে। এই হাওরটির মোট আয়তন ১০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ৪ হাজার হেক্টর প্লাবন ভূমি, ৪ হাজার ৫১৭ হেক্টর হাওর, এক হাজার ৪০০ হেক্টর বিল, ৪০ হেক্টর খাল ও ৫০ হেক্টর নদী।

স্থানীয় মৎস্য অফিস জানায়, হাইল হাওর মৎস্যসম্পদে পরিপূর্ণ জলাভূমি। এখানে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে কয়েক হাজার মানুষ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাইল হাওরে আগে ৯৮ প্রজাতির মাছের আবাস থাকলেও বর্তমানে ২১ প্রজাতির মাছ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও ১১ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মাছগুলো হলো-বাচা, ঘারুয়া, ছেপচালা, বাঘাইড়, ঢেলা, রিটা, বাঁশপাতা, রানী, নাফতানি, নাপিত কই, তারা বাইম, বামোশ, বড় বাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা, একথুটি, চাকা, শ্বেত সিংগি, শ্বেত মাগুর মাছ। বিলুপ্তপ্রায় মাছের মধ্যে রয়েছে, পাবদা, আইড়, বেদা, মিনি, ফলি, গজার, গুলশা, দাড়কিনি, চিতল, টাটকিনি ও তারা বাইম। এই হাওরে কুড়া পাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও জলজ প্রাণী দেখা যায়। এ ছাড়া শীত মৌসুমে হাইল হাওরে ২০ হাজারের বেশি দেশীয় এবং অতিথি পাখির আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে হাইল হাওরের বড় একটি অংশ দখল করে ফেলেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। মাটির পাড় তুলে শত শত একর জুড়ে নিশ্চিত করেছে তাদের দখলদারিত্ব। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওরের ভাড়াউড়া অংশে শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভানুলাল রায়ের দখলে রয়েছে সাত শত একর, রাজা মিয়ার দখলে পাঁচ হাজার একর, হুজুর হামজা মিয়ার দখলে রয়েছে আট শত একর। এমন করে হাইল হাওরজুড়ে রয়েছে সাত শত দখলদার, প্রত্যেকে গড়ে তুলেছে কথিত বাণিজ্যিক ফিশারিজ।

হাইল হাওরে দীর্ঘ ১৫ বছর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন মৎস্যজীবী সামাদ মিয়া। তিনি জানিয়েছেন, হাইল হাওর দখল হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে হাজার হাজার মৎস্যজীবী বেকার হয়ে যাবে। স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সংগঠন বড় গাঙিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সম্পাদক মিনত আলী খোলা কাগজকে বলেন, দখলসহ বিভিন্ন কারণে হাইল হাওর জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছে। প্রতি বছর দুই সেন্টিমিটার করে হাইল হাওরের তলদেশে বালু ভরাট হচ্ছে। মাটি ভরাট করে অনেকে বসতবাড়িও তৈরি করছে। তিনি বলেন, এতে মাছ কমে যাচ্ছে, ঝুঁকিতে পড়ছে মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা।

মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম ইদ্রিস আলী খোলা কাগজকে জানান, ফিশারির নামে হাইল হাওর দখল হচ্ছে। দায়িত্বশীল কেউ হাওর সুরক্ষায় আওয়াজ তুলছে না। তিনি বলেন, প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দিনকে দিন হাওর দখল করে চলছে।

হাওরের জলাভূমি নিয়ে ১০ বছর ধরে গবেষণা করছেন স্টামফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি খোলা কাগজকে জানান, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্যর জন্য হাওর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হলে, আশপাশের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, হাইল হাওর সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এটিকে রামসার সাইট ঘোষণা করা যেতে পারে। কারণ রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃত পৃথিবীর অন্যান্য জলাভূমির বৈশিষ্ট্য হাইল হাওরে রয়েছে। রামসারের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিশেষ সংরক্ষণের আওতায় আসবে। যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন খোলা কাগজকে বলেন, ‘হাওরের বিভিন্ন জমি আমরা লিজ (ইজারা) দিয়ে থাকি, মেয়াদ শেষ হলে নবায়ন করি। হাওরকেন্দ্রিক বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আমরা প্রতি মাসে মিটিং করি।’ তিনি বলেন, ‘হাওর দখল নিয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে কেউ অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

 
Electronic Paper