ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পর্বতের মূষিক প্রসব

এডিস নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ

কুন্তল দে
🕐 ১০:৫৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২২, ২০১৯

মশা নিধনে নতুন ওষুধ আনা, সচেতনামূলক কর্মসূচি, দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ, বাড়িতে বাড়িতে চিরুনি অভিযানসহ নানা তোড়জোড়ের পরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু। আগস্টের প্রথম দিকের তুলনায় শেষভাগে এসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও শঙ্কা কাটছে না। ঈদের পর প্রতিদিনই কমবেশি দেড় হাজারের মতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ডেঙ্গুতে। তথ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার তুলনায় দেশের অন্যান্য জেলাতে আক্রান্ত রোগী বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের বৃহস্পতিবার পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজার ছুঁই ছুঁই। মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসবে ৪৭ বলা হলেও গণমাধ্যমের হিসাবে এ সংখ্যা ১৭৫ পেরিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নিয়ে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা যাতে না কামড়াতে পারে এজন্য মশারি, মশানিরোধক ওষুধ, অ্যারোসলসহ মশাপ্রতিরোধী নানাকিছুর ব্যবহার বাড়ছে। অনেক সচেতন নাগরিক নিজ উদ্যোগেই এডিস মশা জন্ম নিতে পারে এমন জমানো পানির পাত্র পরিষ্কার করছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা না কমায় এডিস মশার কেন্দ্র ঢাকার মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন, ডেঙ্গু মোকাবেলায় যত দ্রুত ও যতটা সমন্বিত, পরিকল্পিত ও বড় পরিসরে উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল সে তুলনায় যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হচ্ছে তা বিচ্ছিন্ন আর অপ্রতুল। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা ও সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত মশা নিয়ন্ত্রণের বাস্তবসম্মত কাজের ক্ষেত্রে তাদের তৎপরতা খুবই কম। এডিস মশা নিধনে সীমিত উদ্যোগকে অনেকটা পর্বতের মূষিক প্রসব বলে মনে করছেন।

২৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা মহানগর বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মহানগর। এ মহানগরের লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। প্রতি বর্গকিলোমিটারে দেড় লাখের মতো মানুষ বাস করে। বিপুল জনসংখ্যার অপরিকল্পিত এ মহানগর এডিস মশার জন্য বলা চলে স্বর্গরাজ্য। ভবনের সঙ্গে ভবন লাগানো আবাসন, অফিস, নির্মাণাধীন ভবন, বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প, হাসপাতাল, বাস-ট্রেন-লঞ্চ টার্মিনালগুলো এডিস মশার প্রজননের উপযুক্ত জায়গা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও এখানে দুর্বল।

বিপর্যয়কর এই পরিবেশে এডিস মশার বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ছয় বছর আগেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সতর্ক করেছিল ঢাকা ডেঙ্গু বোমার ওপর বসে আছে। তাদের সেই সতর্কতা এ বছরে সত্যিই ফলে গেছে। এতসব সমস্যার জঞ্জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ঢাকা নগরের দেখভালের দায়িত্ব দুই সিটির। কিন্তু বাংলাদেশের যে প্রশাসনিক কাঠামো সেখানে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অনেকটাই ‘দুধভাত’-এর মতো। কাজের পরিধি, ক্ষমতা, লোকবল সব ক্ষেত্রেই হাত-পা বাঁধা দুই সিটি। এ কারণে ডেঙ্গু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে কর্মপরিকল্পনা আর কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সেখানে সরকারের পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে।

ডেঙ্গুর বৈশ্বিক পরিস্থিতি, গত বছরে দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এবং মার্চ মাসে ঢাকার এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ে জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর আগেই সতর্ক করেছিল এ বছরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। কিন্তু এ সতর্কতা আমলে নেয়নি সিটি করপোরেশন। জুলাই মাসে যখন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে তখনো পরিস্থিতির গুরুত্ব না বুঝে সেটাকে অস্বীকার শুরু করে দুই সিটি। মশা নিয়ন্ত্রণে পুরনো গৎবাঁধা পথেই ফগার মেশিন থেকে ধোঁয়ার মাধ্যমে ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারা চলতে থাকে। এসব ওষুধ ছিল অকার্যকর।

এ ছাড়া এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ফগারের ব্যবহারও অকার্যকর। ফলে এডিস মশা আর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে হু হু করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের কীটতত্ত্ববিদরা বলতে শুরু করেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন সনাতন যে পদ্ধতিতে মশা নিধন করে সেটা এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজে আসবে না। পদ্ধতিটা পুরোপুরি ভুল।

পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় কলকাতার কাছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা শোনে ঢাকা। তাতে আরও পষ্ট হয়, এডিস মশার উৎস নির্মূল না করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের কর্মপরিকল্পনা ঢেলে সাজাতে হবে। কাছাকাছি সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কীটতত্ত্ববিদ এসে জানান, শুধু বাসা বাড়ি, স্কুল, অফিস, আদালত নয় এডিস মশার সবচেয়ে বড় উৎসস্থল হলো, পরিবহন পুল, হাসপাতাল, বাস-ট্রেন টার্মিনাল, নির্মাণাধীন ভবন ও নির্মাণ প্রকল্প। সবারই পরামর্শ হলো, এডিস মশা নিধনে রয়েছে ভিন্ন তরিকা। এ মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনা একেবারেই ভিন্ন। ব্যাপক সচেতনার মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই খুব দ্রুতই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।

এ প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার দেড়মাস পর গত এক সপ্তাহে এডিস মশা নিধনে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে দুই সিটি করেপোরেশন। মশক নিধন কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো, নতুন ফেশিন কেনা, নতুন ওষুধ আনা ও ছিটানো, সচেতনামূলক প্রচারণা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস, নির্মাণাধীন ভবনে অভিযান ও জরিমানা, স্কুলগুলোতে অ্যারোসল বিতরণ করা হচ্ছে। ছুটিও বাতিল করা হয়েছে সিটি করপোরেশনের সব পর্যায়ের চাকুরেদের। তবে এত উদ্যোগের পর বাস্তব সংকটের তুলনায় তা কতটা ফলপ্রসূ এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এডিস মশা নিধনে গত ২০ আগস্ট থেকে চিরুনি অভিযান শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ওয়ার্ডভিত্তিক এ অভিযান চালানো হবে ২০ দিন। এ অভিযানে প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০ ভাগে ভাগ করে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালাচ্ছেন। এডিস মশার লার্ভা আছে কিনা তা বাসায় বাসায় গিয়ে খুঁজে দেখা হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবন, অফিস, দোকান, রেস্টুরেন্টেও চলছে এ অভিযান। কোনো বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে সেই বাড়ির মালিককে প্রথমে সতর্ক করা হচ্ছে। বাড়ির সামনে সতর্ক সংকেত সংবলিত স্টিকার মেরে দেওয়া হচ্ছে। পরের অভিযানে আবার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র।

ঢাকা উত্তর সিটি সূত্রে জানা গেছে, প্রথমদিনে ৬৫৮টি, দ্বিতীয়দিনে ২৬১টি ভবন ও তৃতীয়দিনে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড থেকে ১১৩নং সড়ক পর্যন্ত চিরুনি অভিযান চালানো হয়। এ গতিতে অভিযান চালানো হলে শেষপর্যন্ত কতগুলো ভবনে এ অভিযান চালানো যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা, উত্তর সিটির আওতাধীন এলাকার জনসংখ্যা ২০১১ সালের আদমশুমারিতেই ১ কোটি ৬ লাখ। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কমিউনিটি অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে বলে সেখানকার মেয়র সাঈদ খোকন জানিয়েছেন।

গত মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় পরিচ্ছন্নতা অভিযানে গিয়ে তিনি জানান, তার আওতাধীন ৫৮ হাজার বাসায় সচেতনামূলক অভিযান চালানো হয়েছে। তবে উত্তর সিটিতে এডিস মশা নিধনের অভিযান যতটা স্পষ্ট, দক্ষিণ সিটির ক্ষেত্রে ঠিক ততটা দৃশ্যমান নয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্তদের একটা বড় অংশ শিক্ষার্থী। অভিভাবকদের অভিযোগ অনেকে স্কুলে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে ডেঙ্গুতে। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্কুলগুলোতে অ্যারোসল বিতরণের কর্মসূচি নেয় সিটি করপোরেশন। কিন্তু আগস্টের প্রথম দিকের তুলনায় সে উদ্যোগ এখন অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। পাড়ায়, মহল্লায় ব্যক্তি উদ্যোগে কিংবা সাংগঠনিক উদ্যোগে যে পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়েছিল সেটাতে ভাটা পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগ-নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গণমাধ্যমে বলেন, এখন ডেঙ্গু বেড়েছে বলে এক ধরনের কাজ হচ্ছে, সেটা একটু কমলে যদি এসব কার্যক্রম থামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু সমস্যা। এটা চালিয়ে যেতে হবে, এটা কিন্তু ওয়ার টাইম ইস্যু নয়। আমাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে যে মশার উৎস নির্মূলই কিন্তু এখানে প্রধান কাজ, কীটনাশকের ভূমিকা পরে। ফলে এখানে মশার উৎস নির্মূল করার ব্যাপারে জোর দিতে হবে।’

এ কাজে নাগরিকদের ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত না করা গেলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। বলেন, সরকারের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদেরও এক্ষেত্রে অনেক বেশি হারে সম্পৃক্ত হওয়ার দায়িত্ব রয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও মশাবিশেষজ্ঞ কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। কারণ এডিস মশা তাৎক্ষণিকভাবে নির্মূলের ব্যাপার নয়। সারা বছর ধরে এডিসের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে চারটি ব্যাপার নিশ্চিত করা জরুরি। এক. পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা, দুই. মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, তিন, কীটনাশক প্রয়োগ, চার. ঠেকাতে নাগরিকদের যুক্ত করা।

হাসপাতালে ভর্তি ৬০ হাজারের কাছাকাছি
চলতি বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬০ হাজারের কাছাকাছি। সরকারি হিসাবে অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুসারে ১ জানুয়ারি থেকে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) পর্যন্ত সারা দেশে হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৫৯ হাজার ৫৯২ জন।

ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে চলতি মাসের ২২ দিনে (২২ আগস্ট পর্যন্ত) রেকর্ড সংখ্যক ৪১ হাজার ১৩১ জন ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মারা গেছেন ৪৭ জন। এদিকে সরকারি হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি হিসেবে গরমিল রয়েছে। বেসরকারি হিসেবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, হাসপাতালে ভর্তি ও আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি।

একাধিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, সরকারি হিসাবে শুধু রাজধানীর ৪১টি সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল এবং বিভাগীয সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী তথ্য-উপাত্ত দেখানো হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও অসংখ্য হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন, যা হিসাবের মধ্যে আসেনি। ডেঙ্গু আক্রান্তের মত মৃত্যুর হিসেবেও গরমিল রয়েছে।

তারা আরও বলেন, সরকারি হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ডেথ রিভিউ কমিটির পর্যালোচনায় ঘোষিত মৃত্যুর সংখ্যা দেখানো হয়। বাস্তবতার সঙ্গে যার গরমিল রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুসারে গত কয়েকদিন যাবৎ ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমতির দিকে। গত ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ ২১ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে আজ ২২ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৫৯৭ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর ৪১টি হাসপাতালে ৭৬১ জন ও বিভাগীয় শহরে ৮৩৬ জন ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর প্রায় ৬০ হাজার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও ইতোমধ্যে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন ৫৩ হাজার ৩৯৮ জন।

বর্তমানে সারা দেশের হাসপাতালে ৬ হাজার ১৪৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে রাজধানীতে ৩ হাজার ৩৩২ জন ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ২ হাজার ৮১৫ জন ভর্তি রয়েছেন। ডেঙ্গু ঢাকা থেকে ছাড়ালেও ঈদেও পর থেকে ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে বেশি রোগী আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৬০ জন। আর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৩৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে ১২২ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০২ জন এবং মুগদা মেডিকেলে ৮৮ জন। আর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে ১৩৯ জন, খুলনায় ১৭৯ জন এবং বরিশালে সর্বোচ্চ ১৩৭ জন ভর্তি হয়েছেন।

প্রাণ গেল আরও ছয়জনের
এডিস মশাবাহিত ভাইরাস জ্বর-ডেঙ্গু আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন দেশবাসী। প্রায় প্রতিদিনই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কারও না কারও মৃত্যুর খবর আসছে। বৃহস্পতিবারও ডেঙ্গু আক্রান্ত ছয় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় চার, বরিশাল ও সাতক্ষীরায় একজন করে মোট ছয়জন মারা যান।

বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান মো. গিয়াস উদ্দিন নামে দুই সন্তানের বাবা। এর কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আরেক নারী।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোর ৬টা ২০ মিনিটের দিকে গিয়াস উদ্দিনের মৃত্যু হয় বলে মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান। গিয়াস চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার পশ্চিম শিংরা গ্রামের আব্দুল আউয়ালের ছেলে। পরিবার নিয়ে ঢাকার
পোস্তগোলা এলাকায় থাকতেন তিনি।

তার বড় ভাই জাহাঙ্গীর বলেন, প্রচণ্ড জ্বর হলে গত বুধবার রাত ১১টার দিকে গিয়াস উদ্দিনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বুধবার ১২টার দিকে আমাকে ফোন করে জানায়, তার শরীর ভালো না। আমার আরেক ছোট ভাই তাকে নিয়ে প্রথমে একটা বেসরকারি হাসপাতালে যায়। সেখানে তাকে রাখে না। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমিও সেখানে যাই। রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। অবস্থা খারাপ হলে তারে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। জাহাঙ্গীর জানান, গিয়াস উদ্দিন পাথরের ব্যবসা করত। শ্যামপুরের ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরি এলাকায় তার আড়ত। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

এদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মামুন মোর্শেদ জানান, ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুরে এক নারীর মৃত্যু হয়। গত মঙ্গলবার রাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি আমাদের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মারা যান। তাৎক্ষণিকভাবে ওই নারীর নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি ডা. মামুন।

৯৪ চিকিৎসকসহ ৩০০ স্বাস্থ্যকর্মী ডেঙ্গু আক্রান্ত
ডেঙ্গু রোগীদের সেবায় নিয়োজিত ৩০০ স্বাস্থ্যকর্মী মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের ৯৪ জনই চিকিৎসক। রাজধানীতে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার পর রোগীদের সেবায় নিয়োজিত তারা এ রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। একক হিসাবে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী সামলানো এ সরকারি হাসপাতালের ২৫ জন চিকিৎসকসহ ৬২ জন কর্মী এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে।

হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুয়ায়ী, বর্তমানে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছয়জন চিকিৎসক এবং ১২ জন নার্স রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের বাইরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে দুজন এবং কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে দুজন কর্মী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন।

গত জুনে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর ক্রমেই তা বেড়েছে। সরকারি হিসাবে-এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯ হাজার ৫৯২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালকর্মী ৩০০ জন বলে গত বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়। এতে বলা হয়, গত ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৯৪ জন চিকিৎসক, ১৩০ জন নার্স এবং ৭৬ জন হাসপাতালকর্মী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

 
Electronic Paper