ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আরও জটিল হতে পারে ডেঙ্গু পরিস্থিতি, ভরসা সতর্কতা

চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার ছুঁলো

কুন্তল দে
🕐 ১০:৪৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৬, ২০১৯

জুলাইয়ের শেষ এবং আগস্টের শুরুতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রায় মহামারী পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মাঝে। স্বাস্থ্য অধিদফতর, দুই সিটি করপোরেশন, কীটতত্ত্ববিদ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গণমাধ্যমের নানা সতর্কতামূলক প্রচারণার ফলে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে ওঠে। এর ফলাফলও পাওয়া যায়। আগস্টের ৭ তারিখে যেখানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ২৪২৮ জনে পৌঁছায় সেখানে পরবর্তী দিনগুলোতে এ সংখ্যা কমতে থাকে। গত ১৩ আগস্ট এ সংখ্যা কমে ১ হাজার ২০০ জন হয়। কিন্তু এরপরের দিন রোগীর সংখ্যা একধাপে ৬০০ জন বাড়ে। গত পরশু হাসপাতালে ভর্তি হয় ১৯২৯ জন। তবে গতকাল এ সংখ্যা ২০০ জন কমে দাঁড়িয়েছে ১৭১৯ জন।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার ছুঁয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪৯ হাজার ৯৯৯ জন। এর মধ্যে ৪২ হাজার ২০০ জন চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪০ জন বলা হলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমের হিসাবে এ সংখ্যা ১৩০-র বেশি।

সরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেই বলা হচ্ছে, প্রথমবার আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর আক্রান্তদের যে তালিকা তৈরি করে সেটা ঢাকা শহরের ৪০টি সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালের দেওয়া তথ্য। এর বাইরেও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে ও ডাক্তারের চেম্বারে ডেঙ্গু আক্রান্তরা চিকিৎসা নিয়েছেন। আর এ বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ অনেকে দ্বিতীয়বারের মতো এ অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রথমবারের তুলনায় দ্বিতীয়বার যারা আক্রান্ত হন তাদের ঝুঁকি অনেকগুণ বেড়ে যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে এডিস মশা নিধন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের কারণে এবারেই জানা গেল, এডিস মশা মারার কোনো ব্যবস্থাপনা জানা ছিল না দুই সিটি করপোরেশনের। ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের কারণে এডিস মশা নিধনের নানা কর্মসূচি ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু হলেও ঈদের ছুটির কারণে এর ভাটা পড়েছে। আবার এ কদিনে ঢাকাতে থেমে থেমে বৃষ্টিও হয়েছে। ফলে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ার উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। এ ছাড়া ফাঁকা বাসাবাড়ি ও অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, নির্মাণাধীন ভবন ও নির্মাণকাজে নজরদারি কম হওয়ায় সেখানে মশা ডিম পাড়ার পরিবেশ পেয়েছে। জমানো পানিতে এডিস মশার ডিম থেকে তিন দিনেই লার্ভার জন্ম হয়। দুই সিটি করপোরেশন কোরবানির বর্জ্য অপসারণে ব্যস্ত থাকায় এ সময়ে মশা নিধন কার্যক্রমে তেমনটা মনোনিবেশ করতে পারেনি। এ ছাড়া গণমাধ্যমেও ঈদের ছুটির কারণে সচেতনামূলক অনুষ্ঠান কম প্রচার হয়েছে। ডেঙ্গু রোগী কিছুটা কমায় শিথিলতাও এসেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। এসব কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামনে আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এ ছাড়া এবারের প্রকৃতিও অনেকটা এডিস মশার অনুকূলে। ফেব্রুয়ারি মাসে বৃষ্টি হওয়ায় ঢাকায় এ মশার ঘনত্ব বাড়ে। আর জুলাই-মধ্যআগস্টেও খুব একটা ভারী বৃষ্টি হয়নি। আগস্টেও বাকি কদিনে মৌসুমি লঘুচাপের কারণে দু-তিন দফা বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও একটানা ভারীবর্ষণ নাও হতে পারে। থেমে থেমে এ ধরনের বৃষ্টি এডিস মশার প্রজননের জন্য উৎকৃষ্ট পরিবেশ। আগের আগের বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ডেঙ্গুর পিক মৌসুম হচ্ছে সেপ্টেম্বর। কেননা এ সময়ে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। অক্টোবরেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মোটামুটি ডেঙ্গুর অফ-মৌসুম।

এ পরিস্থিতিতে সচেতনতায় এডিস মশা নিধন ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ভরসা। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত, বস্তি, নির্মাণাধীন ভবন, নির্মাণ প্রকল্প, স্কুল-কোথাও জমে থাকা পানি তিন দিনের বেশি না থাকতে পারে সেদিকে নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন পর্যন্ত দুই সিটি করপোরেশন যে ব্যবস্থায় এগুচ্ছে তাতে সফলভাবে এডিস মশা নিধন সম্ভব নয়। সনাতনী এ পদ্ধতি ও প্রযুক্তির বদলে মশা নিধন হতে হবে বিজ্ঞানসম্মত। বর্তমানে বিশে^র প্রায় ১০০টির বেশি দেশ ডেঙ্গুর কবলে। অনেক দেশে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মশা দমনের নানা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি উদ্ভাবিত হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ নতুন নতুন ফাঁদ আবিষ্কার করা হচ্ছে। আমাদেরও উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে। প্রচলিত দমন পদ্ধতির আধুনিকায়ন করতে হবে। তবে এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম। বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতিতে জনগণের ব্যাপক সচেতনায় পারে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১ হাজার ৭১৯ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ পর্যন্ত সারা দেশে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।

আজ (১৬ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪৯ হাজার ৯৯৯ জন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা আগের দিনের চেয়ে ২১০ জন কম। আগের দিন এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯২৯ জন।

হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যেসব নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে ৭৫৯ জন ঢাকা শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ভর্তি হয়েছে আরও ৯৬০ জন। তিনি বলেন, গতকাল পর্যন্ত ঢাকার ৪০টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ৪ হাজার ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। আর ঢাকার বাইরে অন্য জেলাগুলোতে ভর্তি আছেন ৩ হাজার ৭০১ জন।

আজ দুপুরে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা বলেন, আগামী সপ্তাহে বোঝা যাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সরকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবেলায় জোর তৎপরতা চালাচ্ছে।

 
Electronic Paper