ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গুজব থামছে না

গণপিটুনিতে নিহত আরও এক নারী, আহত ১১

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৪৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ২১, ২০১৯

ছেলেধরা গুজব থামছে না। গুজবের ফাঁদে পা দিয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষ। সাত-পাঁচ না ভেবে, কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করে ক্ষুব্ধ লোকজন পিটিয়ে হত্যা করছে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের। গণপিটুনিতে গত শনিবার তিনজনের প্রাণহানির রেশ কাটতে না কাটতেই গতকাল রোববার নির্মম পিটুনিতে আরেকজন নারীর প্রাণ হারানোর খবর পাওয়া গেছে। ছেলেধরা সন্দেহে শনিবার ওই নারীকে পেটানো হলে গুরুতর আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

রোববার সেখানে তার মৃত্যু হয়। তার নাম-পরিচয় কিছু জানা না গেলেও বয়স আনুমানিক ৩০ বলে জানা গেছে। একই দিনে ছেলেধরা সন্দেহে বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনিতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১১ জন। তার মধ্যে নওগাঁয় ছয়জন, টাঙ্গাইলে একজন এবং কুমিল্লায় রয়েছেন চারজন।

সাভার সংবাদদাতা জানান, তেঁতুলঝোড়া এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে আহত এক নারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার বয়স আনুমানিক ৩০ বছর। শনিবার দুপুরে তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নে জনতার পিটুনিতে গুরুতর আহত হন তিনি। তার নাম-পরিচয় এখনো জানাতে পারেনি পুলিশ।

সাভার মডেল থানার ওসি এএফএম সায়েদ বলেন, ছেলেধরা সন্দেহে ওই নারীকে পিটুনি দেয় তেঁতুলঝোড়া এলাকার লোকজন। তবে কোন বাড়ির কার ছেলেকে তিনি ধরে নিয়ে যেতে চেযেছিলেন- তা কেউ বলতে পারেননি। দুপুরে ওই ঘটনার পর গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় ওই নারীকে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে তার মৃত্যু হয়। এ বিষয়ে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা করার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।

নওগাঁ : নওগাঁর মান্দা উপজেলায় ছেলেধরা সন্দেহে ছয় ব্যক্তিকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পরে পুলিশ ওই ছয় ব্যক্তিকে উদ্ধার করে থানা হেফাজতে নেয়। গতকাল রোববার সকালে উপজেলার বুড়িদহ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। গণপিটুনির শিকার ছয় ব্যক্তি হলেন নওগাঁ সদর উপজেলার খাগড়া গ্রামের সাদ্দাম হোসেন, তসলিম হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আবদুল মজিদ আকন্দ ও আনিছুর রহমান এবং সদর উপজেলার ফারতপুর গ্রামের রেজাউল করিম।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৮টার দিকে এই ছয়জন উপজেলার বুড়িদহ গ্রামের রণজিৎ কুমার চৌধুরীর পুকুরে চুক্তিভিত্তিক মাছ ধরতে যান। পুকুরের মালিকের সঙ্গে তাদের চুক্তি ছিল, তারা শুধু ছোট মাছ ধরবেন। কিন্তু তারা কয়েকটি বড় মাছও ধরে ফেলেন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে পুকুর মালিকের কথাকাটাকাটি শুরু হয়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে পুকুরের মালিক ও গ্রামের লোকজন ছয় জেলেকে মারধর করতে শুরু করেন। তারা নিজেদের বাঁচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় গ্রামের লোকজন ‘ছেলেধরা’ বলে চিৎকার করতে শুরু করলে আরও লোকজন ছুটে গিয়ে প্রথমে সাদ্দাম হোসেন নামের এক জেলেকে আটক করেন। ‘ছেলেধরা’ পালিয়ে গেছে খবর রটে গেলে পাশের খুদিয়াডাঙ্গা গ্রামের লোকজন অন্য পাঁচ জেলেকে আটক করে পিটুনি দেয়।

মান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোজাফফর হোসেন বলেন, পুকুরে মাছ ধরা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে গ্রামবাসী ‘ছেলেধরা’ গুজব রটিয়ে ছয় ব্যক্তিকে মারধর করেছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে থানায় নিয়েছে।

কুমিল্লা : কুমিল্লায় ছেলেধরা সন্দেহে ৬০ বছরের দুই বৃদ্ধ ও ৫০ বছরের এক নারীকে পিটিয়ে আহত করার খবর পাওয়া গেছে। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ায় তারা প্রাণে বেঁচে যান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় জেলার সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের ধুতিয়া দিঘীরপাড় এলাকায় এই গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। আহতরা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রামের বাসিন্দা। আহতদের মধ্যে দুই পুরুষের বয়স ৬০ এবং নারীর বয়স ৫০। তাদের নাম-ঠিকানা জানা যায়নি।

আমড়াতলী ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন জানান, রোববার সকালে ওই তিন ব্যক্তি জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেজোড়া গ্রাম থেকে আমড়াতলী স্কুলের সামনে আসেন। পাশের একটি বাড়ির সামনে গিয়ে একটি ছোট শিশুকে ডাক দিলে তাদের আটক করে এলাকাবাসী। পরে একযোগে চলে পিটুনি। খবর পেয়ে দ্রুত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

প্রায় একই সময়ে ছেলেধরা সন্দেহে আরিফ নামে এক যুবককে গণপিটুনি দিয়ে আহত করা হয় বলে জানা গেছে। সদর উপজেলার মাঝিগাছা এলাকায় ওই গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। আরিফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার নয়নপুর এলাকার আবদুর নূর স্বর্ণকারের ছেলে।

কোতোয়ালি মডেল থানার তদন্ত পরিদর্শক সালাউদ্দিন জানান, ছেলেধরা সন্দেহে তাকে গণপিটুনি দিলে খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

টাঙ্গাইল : ছেলেধরা সন্দেহে একইভাবে এক যুবককে বেধড়ক পেটানো হয়েছে টাঙ্গাইলে। খবর পেয়ে পুলিশ ওই যুবককে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেছে। গতকাল সকালে সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের কান্দিলা বাজারে এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মজনু মিয়া বলেন, সকালে জানতে পারি কান্দিলা বাজারে ছেলেধরা সন্দেহে একজনকে মারধর করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে বাজারে গিয়ে দেখতে পাই, ওই লোকটাকে ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশকে জানানোর পর পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। তবে মারধরে আহত ওই যুবক ছেলেধরা কি না-তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।

টাঙ্গাইল মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন বলেন, ‘ছেলেধরা কি না তদন্ত শেষে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ বিষয়ে আজ থেকে শহরে মাইকিং করা হবে। কাউকে সন্দেহ হলে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে মারধর না করে পুলিশকে খবর দেওয়ার জন্য জনতাকে অনুরোধ করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ফেসবুক এবং ইউটিউবে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, পদ্মা সেতু নির্মাণে এক লাখ মানুষের মাথা দরকার হবে। এর এ জন্য ৪২টি দল সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা প্রধানত শিশুদের হত্যা করবে। সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়, সেতু করতে মানুষের মাথা দরকার পড়ে না। যারা গুজব ছড়িয়েছে তাদের অন্তত ১০ জনকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু গুজব থামছে না, গত বুধবার নেত্রকোণায় একটি শিশুকে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় একজনকে গণপিটুনিতে হত্যার পর গুজব ডালপালা মেলেছে আরও।

 
Electronic Paper