ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য গোপন করা হচ্ছে?

সুলতান মাহমুদ
🕐 ১০:৩৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০১৯

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে গত জুন ও জুলাই মাসে শিশুসহ একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। অথচ এ তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে। এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা কি তাহলে গোপন করা হচ্ছে।

গত ১৫ জুন রাজধানীর বসুন্ধরার এ্যাপোলো হাসপিটালসে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১১ বছরের এক শিশু মারা যায়। ২৮ জুন রাজধানীর ধানমন্ডির ইবনে সিনা হাসপাতালে ৪২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এ দুটি মৃত্যুর খবর গত মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তে লিপিবদ্ধ ছিল না।

আজ (১৭ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতরে এ দুজনের মৃত্যুর পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করা হয়। এ নিয়ে সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচজনে দাঁড়াল। বেসরকারি হিসাবে এ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলতি মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একজন মারা গেছেন বলে হাসপাতালটির পরিচালকের অফিস থেকে জানা গেলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত পরিসংখ্যানে সে তথ্য দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ফরিদপুরে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তার মেয়ে (একটি শিশু) এবং রাজধানীতে পরিবেশ অধিদফতরের এক কর্মকর্তার মেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বরাত দিয়ে ওই পরিবারগুলোর সদস্যরা জানিয়েছেন। কিন্তু সেই তথ্যও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যানে নেই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিষয়টি আমরাও শুনেছি। কিন্তু ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হলে তা নিশ্চিত করার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেথ রিভিউ কমিটি রয়েছে। তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে- এমন তথ্য পেলে সরেজমিন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে। তবেই ডেঙ্গুজ্বরে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। তখন ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। মোট আক্রান্তের মধ্যে চলতি জুলাই মাসেই (১৭ জুলাই পর্যন্ত) ৩ হাজার ৮১ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

এ ছাড়া জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ১৮, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মেতে ১৯৩ ও জুনে ১ হাজার ৭৬১ জন আক্রান্ত হন। চলতি বছর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পাঁচজনের মধ্যে এপ্রিলে ২, জুনে ২ ও জুলাই মাসে একজন মারা যান। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে ২১৭ জন ডেঙ্গজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

মশা নিধনে অকার্যকর ওষুধ ২ সিটিকে তদন্তের নির্দেশ
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টিসহ মশা নিধনে ওষুধ আমদানি ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সেই সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে সারা দেশে আগামী ২৫ থেকে ৩১ জুলাই মশক নিধন সপ্তাহ পালন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

গতকাল বুধবার জনস্বার্থে করা এক রিট শুনানি নিয়ে বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ তদন্তের আদেশ দেন। পাশাপাশি মশা নিধনে কার্যকর ওষুধ আমদানি এবং ছিটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে সরকারের সহায়তা নিতেও বলেছেন আদালত। আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। সিটি করপোরেশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী নূরুন্নাহার নূপুর।

শুনানিতে সিটি করপোরেশনের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বিচারকরা বলেন, ‘ডেঙ্গু মহামারি হতে আর বাকি নেই। মশার জন্য আমরা পদক্ষেপ নিতে বলেছিলাম, নেননি। আমরা কথা বললে তো বলেন বড় বড় কথা বলছি। ডেঙ্গুতে ২১-২২ জন মানুষ মারা গেছেন, তারপরও সিটি করপোরেশন বলছে ‘কিছু না’। মেয়র বলেন ‘কিছুই হয়নি’। ২১-২২ জন মানুষ মারা গেছেন, কয়েক হাজার মানুষ অসুস্থ, আচরণ চেঞ্জ করেন।’

আদালত বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। তখন থেকে ব্যবস্থা নিলে আজ এমনটা হতো না। যার সন্তান মারা গেছে সেই বোঝে কষ্টটা কী। ছোটো ছোটো বাচ্চারা আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন খবরে দেখছি, মানুষ মারা যাচ্ছে।’

এ সময় সিটি করপোরেশনের আইনজীবী নুরুন্নাহার নূপুর বলেন, ‘এগুলো দেখলে-পড়লে খারাপ লাগে।’

তখন বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক কে এম কামরুল কাদের বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের খারাপ লাগে না। কারণ তারা বাড়িঘর দেশের বাইরে করে। তাদের ছেলে-মেয়েরা দেশের বইরে থাকে, ওইখানে পড়ালেখা করে। জরুরি ব্যবস্থা করেন। মশা মারার ওষুধে যদি কাজ না হয় তার মানে অকার্যকর ওষুধ কেনা হয়েছে। ওখানে দুর্নীতি হয়েছে! দুর্নীতি হয়ে থাকলে কারা কারা এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।’

অন্যদিকে ঢাকায় ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় সম্প্রতি সচিবালয়ে এ সংক্রান্ত এক সভায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম মশার ওষুধ সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা জানান। ‘লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস’ নামের ওই কোম্পানির ওষুধ তিনবার ছিটিয়েও মশা নিধনে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যায়নি বলে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান ভাণ্ডার রক্ষক ও ক্রয় কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ওষুধে কমপক্ষে ৮০ ভাগ মশা মরলে সেটাকে কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু তিনবারই তাদের দেওয়া ওষুধে কাক্সিক্ষত পরিমাণ মশা মরেনি। একবার মরেছে ২ ভাগ, আরেকবার ১৮ ভাগ, তৃতীয় দফায় ৫০ ভাগ। তবে এ প্রতিষ্ঠান থেকে কত দিন ধরে ওষুধ নেওয়া হচ্ছে সে তথ্য স্পষ্ট করে দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা। তবে বেশিরভাগ সময় এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই ওষুধ কেনা হতো বলে জানান তিনি।

আজ (১৭ জুলাই) আদালতে রিট শুনানির পর আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থা নিচ্ছে সেটা অকার্যকর। মিডিয়ায় রিপোর্ট এসেছে, যে ওষুধগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর কার্যকারিতা নেই। তারপরও তারা ওষুধগুলো দিচ্ছে। এখানে ২০ থেকে ২২ কোটি টাকার অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যারা এ কাজগুলো করছেন তাদের বিরুদ্ধে সিটি করপোরশেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

আরেকটি রিপোর্টে দেখা গেছে, সিটি করপোরেশন বলছে, নতুন ওষুধ এনে কার্যকরী করতে ৬ মাস সময় লাগবে। আমি বলেছি জনগণের প্রয়োজনে টেন্ডার এবং আইন-কানুনের বাহিরে দ্রুত ওষুধগুলো এনে ব্যবহার করে জনগণের জীবন রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।

২৫-৩১ জুলাই সারা দেশে মশক নিধন সপ্তাহ
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় আগামী ২৫ থেকে ৩১ জুলাই সারা দেশে মশক নিধন সপ্তাহ পালন করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। সচিবালয়ে আজ  জেলা প্রশাসক সম্মেলনের চতুর্থ দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান মন্ত্রী।

তাজুল ইসলাম বলেন, মশার ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা চলছে। আমি ইচ্ছা করলে এমন কোনো ওষুধ পরিবেশে দিতে পারি না যেটা মশা মারতে গিয়ে মানুষের ক্ষতি হয়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আমাদের ওষুধের অনুমতি নিতে হয়। তারা যেটার অনুমোদন দেয় আমরা সেটা ব্যবহার করি।

 
Electronic Paper