ডিআইজি মিজানের সম্পদ
অনুসন্ধান রিপোর্ট দুদকে
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০১ অপরাহ্ণ, জুন ২৩, ২০১৯
পুলিশের বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমানের সম্পদের অনুসন্ধান শেষ হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে কমিশনে জমা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, ডিআইজি মিজানের সম্পদের অনুসন্ধান প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো আবেগী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।
রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন। এর আগে ডিআইজি মিজানের সম্পদ অনুসন্ধানের দায়িত্বে ছিলেন দুদকের কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাসির। তার বিরুদ্ধে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ তোলেন মিজান।
অভিযোগের পর এনামুল বাসিরকে গত ১০ জুন সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান দুদকের আরেক পরিচালক মনজুর মোরশেদ। গত ১২ জুন তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পর এক সপ্তাহের মধ্যে মিজানের সম্পদ অনুসন্ধান সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। দুদকের টিম ছাড়া পুলিশ সদর দফতরের উচ্চপর্যায়ের একটি টিম আলাদাভাবে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে নতুন করে ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে নেমেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মিজানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয় গত বছরের জানুয়ারিতে। এ ব্যাপারে প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদক উপ-পরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। কিন্তু মিজানের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে সরিয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলে বাসিরকে। অনুসন্ধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর পরিচালক এনামুল বাসির ডিআইজি মিজানের বক্তব্য নেন। সঙ্গে তার স্ত্রী রত্নার সম্পদেরও অনুসন্ধান করেন। ডিআইজি মিজানের ভাগ্নে এসআই মাহমুদুল হাসান ও ছোট ভাই মাহবুবুর রহমানের নামে সম্পদ করায় তাদের বক্তব্যও নেন বাসির। পরে তিনি ২৩ মে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশসহ অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দলিল মূল্যে ৪ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার টাকার সম্পদ ডিআইজি মিজানের দখলে রয়েছে। এর মধ্যে তার নিজের নামে ১ কোটি ১০ লাখ ৪২ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ ও ৯৬ লাখ ৯২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। ছোট ভাই মাহবুবুর রহমানের নামে তার নিজের সম্পদ রয়েছে ৯৫ লাখ ৯১ হাজার টাকার। আর ভাগ্নে মাহমুদুল হাসানের নামে রয়েছে তার ১ কোটি টাকার সম্পদ। এর মধ্যে তার আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৯০ লাখ ৭৮ হাজার টাকার। আর ব্যয় পাওয়া যায় ৮৫ লাখ ১২ হাজার টাকার। আয়-ব্যয় বাদ দিয়ে ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৯৭ লাখ ২১ হাজার টাকার। এই আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের দুদক আইনের ২৬(২) ও ২৭(১) ধারাসহ ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইনের ৪(২) ধারায় মামলার সুপারিশ করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাসির।
এ প্রতিবেদন দাখিলের পরপরই ডিআইজি মিজান দুদক পরিচালক বাসিরের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ তোলেন। তিনি অভিযোগ করেন, বাসির তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। ৫০ লাখ টাকার লেনদেনের কথা থাকলেও ৪০ লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি। দুদকের মামলা থেকে রক্ষা পেতে তিনি এ বছরের ১৫ জানুয়ারি দুদক পরিচালককে এই ঘুষ দেন বলে দাবি করেন। কিন্তু এরপরও তার বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করায় তিনি ঘুষ লেনদেনের কথা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।
বাসিরের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর দুদক সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে কমিশন। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পরিচালক এনামুল বাসিরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে তার কাছ থেকে অনুসন্ধানের যাবতীয় নথিপত্র নিয়ে নেয় কমিশন। নিয়োগ দেওয়া হয় পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি। ওই কমিটি গত সাত দিনে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান করে আগের সম্পদের চেয়ে আরও বেশি সম্পদের তথ্য বের হয় বলে জানা গেছে।
এদিকে ডিআইজি মিজানুর রহমান এবং দুদকের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসিরের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে দুদক। একই সঙ্গে মিজানের স্ত্রী, দুই সন্তান এবং ভাই ও ভাগ্নের হিসাব সম্পর্কেও তথ্য চাওয়া হয়েছে। এজন্য গত ১৬ ও ১৮ জুন (রোববার ও মঙ্গলবার) আলাদাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি দেয় দুদক। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও একই ধরনের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট দিতে অনুরোধ জানানো হয়।
অপরদিকে দু’জনের ঘুষের লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য গত রোববার বিশেষায়িত সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেলে (এনটিএমসি) পাঠিয়েছে দুদক। ফরেনসিক রিপোর্ট আসার পর দু’জনের কণ্ঠস্বর এক হলে বা কথোপকথন মিলে গেলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য কমিশনে সুপারিশ করবে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান টিম।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে ডিআইজি মিজান ও দুদক পরিচালক বাসিরের মধ্যে কথোপকথনের সত্যতা মিলেছে! দু’জনের মধ্যে একদিন নয়, একাধিকবার কথা হয়েছে। ‘এসএমএস’ বিনিময় হয়েছে বহুবার। ডিআইজি মিজান দুদক পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটি ফোন ও সিমকার্ড কিনে দেন। বডিগার্ড হৃদয়ের নামে এ ফোন সেটসহ সিম কেনা হয়। সেই নম্বরেই দু’জনের মধ্যে বহুবার কথা হয়েছে। দেখা হয়েছে একাধিকার। দু’দফায় ঘুষ বিনিময় হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। সেই টাকা একটি বেনামি হিসাবে কীভাবে রাখা যায় পরিচালক সেই পরামর্শও চেয়েছিলেন ডিআইজি মিজানের কাছে।
বাংলাদেশ দ-বিধি ও দুদক আইনে ঘুষ দেওয়া-নেওয়া দুটোই সমান অপরাধ। বিশেষ করে কাউকে যদি পরিকল্পনা করে ঘুষের ফাঁদে ফেলা হয়, তাহলে যিনি এ কাজটি করেছেন তিনিও একই ধারায় আসামি হিসেবে সাব্যস্ত হবেন। দণ্ডবিধির ১৬১ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় (ক্ষমতার অপব্যবহার) দু’জনের বিরুদ্ধে মামলা এমনকি বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারেরও ক্ষমতা আছে দুদকের হাতে। এখন দুদকের অনুসন্ধান টিম দু’জনের অডিও রেকর্ডসংক্রান্ত ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে। এ সপ্তাহেই রিপোর্টটি পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে।