ইরান-মার্কিন উত্তেজনা
পষ্ট হচ্ছে মেরুকরণ
হরমুজ প্রণালিতে মার্কিন গোয়েন্দা ড্রোন ধ্বংস
ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ১১:১৭ অপরাহ্ণ, জুন ২০, ২০১৯
হরমুজ প্রণালির ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করার মধ্য দিয়ে উপসাগরীয় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। ইরানের রেভ্যুলিশনারি গার্ডস দাবি করেছে, মার্কিন ড্রোনটি ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি হচ্ছে, এটি আন্তর্জাতিক আকাশসীমাতেই ছিল। যুক্তরাজ্যের সংবাদ মাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে ড্রোনটি আকাশের অনেক উপর দিয়ে গোয়েন্দা নজরদারি করছিল।
কয়েক বছরের স্থিতিশীল সম্পর্কের পর সম্প্রতি ইরান-মার্কিন সম্পর্কের বেশ খানিকটা অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সেনা বাড়িয়ে সামরিক শক্তি আরও পোক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পুরাতন শত্রুভাবাপন্ন দুই দেশের এই বিরোধ ও উত্তেজনায় আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। যতই দিন যাচ্ছে বৈশ্বিক মেরুকরণ পষ্ট হচ্ছে। সৌদি আরব চাইছে যাতে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্র যুক্তরাজ্য ইরানের সমালোচনা করলেও দুপক্ষকে সংযত আচরণের পরামর্শ দিয়েছে। অন্যদিকে ইরানের মিত্র রাশিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইনের বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য বলেছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখন যে পরিস্থিতি তাতে দুই দেশ পরিকল্পিত যুদ্ধে লিপ্ত নাও হতে পারে। তবে উত্তেজনার পারদ বেড়ে যাওয়ায় ভুলবশত ছোটখাটো যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তাতে করে শুধু ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংকটে পড়বে না, সারা বিশ্বের তেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। কেননা বিশে^র অন্যতম বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ ইরান এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনোরূপ হামলা করে তবে তারা বিশ্বের তেল সরবরাহের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে।
নতুন করে সংকটের শুরু গত মে মাসে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমুদ্রসীমায় নিজেদের দুটি বাণিজ্যিক জাহাজে চারটি লিমপেট মাইন হামলার অভিযোগ করে সৌদি আরব। ইরানের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলে দেশটি। এ ঘটনায় উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিনীদের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদির হয়ে তেহরানকে দোষারোপ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমে বাগযুদ্ধ। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। এরপর গত সপ্তাহে ওমান উপসাগরে জাপানি পতাকাবাহী দুটো তেলের ট্যাংকারে হামলা হয়। ওই হামলার পর দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। ওই অঞ্চলে বাড়তি সেনা মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গভীর উদ্বেগ। এর মধ্যেই গতকাল হরমুজ প্রণালিতে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করল ইরান।
গোয়েন্দা ড্রোন গুলি করে নামানোর মধ্য দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে কোনোরকম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিল দেশটির রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)। রাষ্ট্রীয় টিভিতে গতকাল রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার ইন চিফ হুসেইন সালামি বলেছেন, মার্কিন চালক বিহীন গোয়েন্দা বিমান ‘ড্রোন’ ভূপাতিত করে ইরানের ঘোর শত্রু যুক্তরাষ্ট্রকে ‘পরিষ্কার বার্তা’ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সীমান্তই হচ্ছে ইরানের চরম সীমা (রেড লাইন) এবং আমরা কোনোরকম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিক্রিয়া জানাব। ইরান কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধে যাবে না। তবে আমরা ইরানকে রক্ষা করতে পুরোপুরি প্রস্তুত।’
যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন ভূপাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশের দাবি নাকচ করে দেয়। তারা বলে, ড্রোনটিকে যখন হরমুজ প্রণালির ওপর একটি ভূমি থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন এটি আন্তর্জাতিক আকাশসীমাতেই ছিল।
তেল বাণিজ্যের জন্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালিতেই গত সপ্তাহে দুটি তেলের ট্যাংকারে হামলা হয়েছিল। সেই হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইরানকেই দায়ী করে। তবে তেহরান এর দায়িত্ব অস্বীকার করে। ওই ঘটনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, তেলের ট্যাংকার দুটোতে হামলার হোতা যে ইরান, তার প্রমাণ সর্বত্র। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন থেকে কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়। একটি ছবিতে দেখা যায়, জাপানি পতাকাবাহী ট্যাংকারের খোলে বিরাট একটি ফুটো, যারা পাশে অবিস্ফোরিত একটি মাইনের কিছু অংশ। আরেকটি ছবিতে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর সদস্যরা অবিস্ফোরিত একটি মাইন সরিয়ে নিচ্ছে। এরপরই মার্কিন অস্থায়ী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্যাট্রিক শানাহান ঘোষণা দেন, আত্মরক্ষার্থে মধ্যপ্রাচ্যে আরও এক হাজার সৈন্য পাঠানো হচ্ছে। গত মাসেই সেখানে দেড় হাজার সৈন্য মোতায়ের করা হয়। ইরান দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্রের এসব দাবি বানোয়াট। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, ইরানকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের মূল লক্ষ্য ইরানকে একঘরে করা।’
এদিকে বৈরীভাবাপন্ন দুই দেশের বিপজ্জনক এই উত্তেজনা প্রশমনে সারা বিশ্ব থেকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। তবে তেল বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে অনেক দেশই বিভক্ত হয়ে পড়ছে। যুক্তরাজ্য যথারিতি ইরানকে দোষারোপ করছে। যদিও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট দুপক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনে অনুরোধ করে বলেছেন, ‘এই বিরোধের দুটো পক্ষই মনে করে অন্যপক্ষ যুদ্ধ চায় না।’ জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশ ইরানকে সমালোচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা দোষারোপের অবস্থান সমর্থন করছে না। কিছুটা নিরপেক্ষভাবেই তারা ঘটনাপ্রবহের পর্যবেক্ষণ করছে।
যদিও ফ্রান্স উপসাগরীয় অঞ্চলের চলমান উত্তেজনা প্রশমনে তেহরানে তাদের উচ্চপর্যায়ের দূত পাঠিয়েছে। তবে ইরানের আঞ্চলিক শত্রু সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইরানের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না কিন্তু আমাদের জনগণ, দেশ ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়লে, আমরা জবাব দিতে কুণ্ঠাবোধ করব না।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে যুদ্ধের ‘উস্কানি’ না দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া। রুশ ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রিবকভ বলেন, ‘আমরা বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সেই সঙ্গে সামরিক চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে। অস্থিতিশীল এই অঞ্চলে এ ধরনের অবিবেচনা-প্রসূত কাজ থেকে বিরত থাকতে আমরা তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) এবং ওই অঞ্চলে তাদের মিত্রদের বারবার সাবধান করেছি।’ চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং-ই বলেন, অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির যে কৌশল, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তা পরিহার করা। একতরফা আচরণ আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
যুদ্ধের শঙ্কা কতটুকু
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাস্তবিকপক্ষেই বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে যে, হামলার শিকার হলে ইরান সরাসরি বা তার মিত্র দেশগুলোর সহায়তায় হাইব্রিড যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। জাহাজ পরিচালনা ও অন্যান্য টার্গেটে ব্যাপকহারে হামলা শুরু করতে পারে। এতে বাড়তে পারে তেল ও বীমার দাম। যা আসলে আরও শাস্তিমূলক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে।
তারা মনে করছেন, আমেরিকানদের জন্য, পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও ইরানের বিরুদ্ধে বিমান ও নৌ হামলা সব ধরনের বিপদ ডেকে আনবে। এ ছাড়া ট্রাম্প তার আমলে অনেক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিলেও বিদেশে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ধৈর্যশীল ছিলেন।