বঞ্চিত স্বাস্থ্য-পুষ্টিতেও
উপেক্ষিত উত্তরবঙ্গ ৯
সাজ্জাদ হোসেন
🕐 ১০:৩৬ অপরাহ্ণ, জুন ১৬, ২০১৯
রংপুর বিভাগের ৫৮টি উপজেলার ১ কোটি ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার মানুষের প্রধান ভরসা রংপুর মেডিকেল কলেজ। মেডিকেল কলেজের সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ড হাসপাতাল কম্পাউন্ডের একেবারে বাইরে। ভবনের চারপাশ নোংরা আবর্জনায় ফাসা এবং দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস ফেলা দায়। রোগীদের জন্য শৌচাগার আছে কিন্তু নেই কোনো দরজা। টিউবওয়েলও বিকল। সংক্রমণজনিত রোগীদের আলাদা রাখার কথা থাকলেও রাখা হয়েছে সাধারণ রোগীদের সঙ্গে। এমনকি, নারী-পুরুষের জন্যও নেই আলাদা ওয়ার্ড।
রংপুরের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। এর কোনোটি ৩১, কোনোটি ৫০ শয্যাবিশিষ্ট। এর মধ্যে মিঠাপুকুর, গঙ্গাচড়া, পীরগঞ্জ উপজেলার কমপ্লেক্সগুলো ৫০ আর বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, কাউনিয়া, পীরগাছা উপজেলার কমপ্লেক্সগুলো ৩১ শয্যার। নিয়মানুযায়ী ৩১ শয্যার হাসপাতালে ৯ জন চিকিৎসক থাকার কথা। এর মধ্যে একজন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, একজন আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা, দুজন মেডিকেল কর্মকর্তা, একজন জুনিয়র সার্জন (গাইনি), একজন মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ, একজন পুষ্টিবিদ, একজন অ্যানেস্থেশিয়ান, একজন ডেন্টিস্ট এবং একজন হারবাল চিকিৎসক। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই ১ থেকে ২ জনের বেশি ডাক্তার নেই। নেই সার্জন, গাইনি ও পুষ্টিবিদ। ফলে রংপুর এলাকার রোগীদের রংপুর মেডিকেলকেই তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য যেতে হয়।
এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, পঞ্চগড় সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার মান অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় রংপুরেই ভিড় জমান রোগীরা। দিনে গড়ে প্রতিটি বিভাগে রোগী ভর্তি থাকে ২ হাজারের বেশি। আর অপারেশনের জন্য ভর্তি থাকে প্রায় ১০০ জন। এই ১০০ জন রোগীর বিপরীতে এখানে রয়েছের মাত্র ১টি অপারেশন থিয়েটার। ফলে সব রোগীকে অপারেশন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। যাদের সম্ভব হয় না তাদের পাঠানো হয় প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালের মান নিম্ন হওয়ায় এবং দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের মানুষ অর্থ সংকুলান না করতে পারায় অনেক সময় বিনা চিকিৎসায় মরতে হয় রোগীদের।
রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলায় রয়েছে ১১টি উপজেলা। কিন্তু এখানে গত বছর একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হলেও এখনো অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মেডিকেল কলেজের সুবিধা পাচ্ছেন না এ এলাকার মানুষ। ফলে জেলার সবচেয়ে উত্তরের উপজেলা ধামইরহাট কিংবা পশ্চিমের উপজেলা পোরশায় কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে তাকে নিয়ে যেতে হয় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। ১১টি উপজেলার প্রতিটিতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও সেগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসা (ফার্স্ট এইড) ছাড়া আর কোনো গুরুতর রোগীর চিকিৎসা হয় না। একই অবস্থা নাটোর, পাবনা, জয়পুরহাটের। এসব এলাকার রোগীদের ভরসা করতে হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর। কিন্তু সেখানেও ডাক্তার সংকট, অপর্যাপ্ত অপারেশন সুবিধাসহ নানা সীমাবদ্ধতায় আক্রান্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা।
মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গ যুগ যুগ ধরেই অবহেলিত এক জনপদ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ২০১০ সালে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ, ৮ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ। আর দেশের সবচেয়ে গরিব দরিদ্র মানুষ এখন বাস করে রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলায়। এ জেলার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই গরিব। এরপরই অবস্থান দিনাজপুরের। এ জেলায় দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে ৬৪ শতাংশ মানুষ। আর এই দরিদ্র জনসাধারণের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর কোনো ক্ষমতা নেই। আবার সরকারও তেমন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ অঞ্চলে দিন দিন অপুষ্টির শিকার হওয়া শিশুর হার বাড়ছে। ফলে সারা দেশে যেখানে শিশু মৃত্যুর হার কমে হাজারে দুইয়ের নিচে নেমেছে উত্তরবঙ্গে সেটি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) আর্থিক সহায়তায় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ উদ্যোগে কিছুদিন আগে তৈরি বাংলাদেশ আন্ডার নিউট্রিশন ম্যাপ বা অপুষ্টি মানচিত্র প্রকাশ করে।
বিবিএস ও ডব্লিউএফপির যৌথ উদ্যোগে হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) বলছে, দারিদ্র্যের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি রংপুর বিভাগে। এখানে উচ্চ ও নিম্ন দারিদ্র্যরেখা পরিমাপে যথাক্রমে ৪২ দশমিক ৩ এবং ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
অপুষ্টি মানচিত্রে দেখা যায়, রংপুর বিভাগে অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছর বয়সের নিচে কম ওজনের শিশুর হার ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। রাজশাহী ৪১ দশমিক শূন্য শতাংশ।
সংস্থাটি মায়ের অপুষ্টির ফলে শিশুকে দুধ খাওয়াতে না পারা, অসচেতনতা, অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবার কারণে আর্থিক দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে না থাকায় পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে বলে মনে করছে।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের বাসিন্দা ও আইনজীবী রাকিব সিদ্দিকী বলেন, রংপুর শুধু স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেই পশ্চাদপদ তা নয় বরং শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগসহ সব নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। উত্তরের মানুষের সঙ্গে সবসময় বৈমাত্রেয় আচরণ হয়েছে। সরকার যদি একটু সুদৃষ্টি দেয় তাহলে এসব সমস্যা সহজেই সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু সরকার আসে সরকার যায় এ অঞ্চলের কোনো অগ্রগতি হয় না। বরং প্রতিবছর পিছিয়ে পড়ে উত্তরের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও জীবনমান।