ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অবহেলিত পর্যটনশিল্প

উপেক্ষিত উত্তরবঙ্গ ৮

সাজ্জাদ হোসেন
🕐 ১০:২৮ অপরাহ্ণ, জুন ১৫, ২০১৯

একসময় দেশের উত্তরাঞ্চল ছিল প্রাচীনতম সভ্যতার লীলাভূমি। মৌর্য ও গুপ্ত রাজাদের শাসনামলে মহাস্থানগড় হয়ে উঠেছিল ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। উত্তরবঙ্গের পুণ্ড্রনগর ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। অতীত ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে উত্তরবঙ্গের দুই বিভাগ রাজশাহী এবং রংপুরের পরতে পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো দর্শনীয় স্থান। কিন্তু উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, প্রচারণার অনীহা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ভালোমানের হোটেল-মোটেল গড়ে না ওঠায় এবং দর্শনীয় স্থানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে উত্তরবঙ্গের গৌরবময় ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশ্বের বুকে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে না।

সেই সঙ্গে দেশের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাময় অঞ্চলটি সবচেয়ে অবহেলিত একটি অংশে পরিণত হয়েছে। অথচ এই উত্তরাঞ্চলে কমিউনিটিভিত্তিক ট্যুরিজমের মাধ্যমে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবর্তিত উত্তরাঞ্চলের বেকার সংখ্যা কমানো সম্ভব। আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের পর্যটন সহায়ক মনোভাব বদলে দিতে পারে উত্তরবঙ্গ পর্যটন উন্নয়নের দুয়ার। বেড়ে যাবে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।

আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল আর বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ দুই এলাকাতেই যেসব পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে সেগুলোকে যোগ করে এই এলাকায় একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। কারণ এই অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় আর কান্তজীর মন্দিরের মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত পর্যটনস্থল যেমন রয়েছে তেমনই আছে পশ্চিমবঙ্গের হিমালয় এবং ডুয়ার্সের জঙ্গল আর চা বাগান। সীমান্তঘেঁষা ভারতের স্থানগুলো যেভাবে প্রচারণায় রয়েছে বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোকে পর্যটকদের সঙ্গে পরিচিত করে তুলতে পারলে সেটি হবে সবচেয়ে লাভজনক এবং আকর্ষণীয় আন্তর্জাতিক পর্যটনকেন্দ্র।

আর সেটা করা সম্ভব হলে প্রতিবেশী দুই বন্ধু রাষ্ট্রের আকর্ষণীয় অংশ পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা পুরো এলাকা দর্শনার্থীরা একেবারেই ঘুরিয়ে ফেলতে পারবেন। কারণ দুই উত্তরবঙ্গেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যেসব দর্শনীয় স্থান, সেখানে এখনো মানুষ যান, তবে বিচ্ছিন্নভাবে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন প্রচেষ্টা নেওয়া না হলেও অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজম নামের পশ্চিমবঙ্গের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই আঞ্চলিক পর্যটনকেন্দ্রের বিষয়ে চেষ্টার কথা জানিয়েছে।

সংগঠনটির প্রধান রাজ বসু একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানান, বগুড়া, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, নওগাঁ, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে যেমন রয়েছে বহু ঐতিহাসিক স্থান তেমনই আমাদের এদিকে আছে দার্জিলিং, কালিম্পং, ডুয়ার্স-তরাই। এ দুটি অঞ্চলকে এক সুতোয় মেলাতে পারলে সব ধরনের জায়গাতেই পর্যটকরা একসঙ্গে ঘুরতে পারবেন।

তিনি বলেন, দুদেশের উত্তরাঞ্চলীয় সার্কিট যে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হবে। ঐতিহাসিক আর সাংস্কৃতিকভাবে এই গোটা অঞ্চলটা তো একই। আর এর অন্যতম যোগসূত্র হচ্ছে তিস্তা নদী। সিকিম হয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা ছুঁয়ে সেটা বাংলাদেশে পৌঁছেছে। তাই এই সার্কিটকে তিস্তা সার্কিট হিসেবেও তুলে ধরা গেলে দুই বাংলার উত্তরাঞ্চলকে মিলিয়ে একটি কমপ্যাক্ট ট্যুরিজম প্রোডাক্ট তৈরি করা সম্ভব, সেটা আন্তঃসীমান্ত পর্যটনের ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

কিন্তু সেই সঙ্গে সংস্থাটি সমস্যার কথাও জানান। তারা জানান, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনকেন্দ্রগুলো এবং এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার জায়গা, প্রচারণা, পরিচ্ছন্নতা সবকিছু আগে থেকেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল সেই তুলনায় সুযোগ-সুবিধা খুবই সামান্য। ফলে একজন আন্তর্জাতিক ট্যুরিস্টকে দার্জিলিং দেখিয়ে নওগাঁ দিনাজপুরে এনে তাদের রাখা সম্ভব হবে না। সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গে কোনো দেশেরই ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই এক দেশের উত্তরাঞ্চলে ঘুরতে গিয়ে কেউ যে চটজলদি স্থানীয়ভাবেই ভিসা জোগাড় করে নেবে সেটা সম্ভব নয়।

তবে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন চাইলে তারা এ দেশেও ভালো থাকার স্থান তৈরি করে দেবে। সেই সঙ্গে যদি বেসরকারি উদ্যোগে কিছু হোটেল-মোটেল গড়ে ওঠে তাহলে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা মিলে একটি বৃহৎ পর্যটন জোন হতে পারে।

পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, উভয় বাংলার পর্যটকরা যখন একে-অপরের দেশে যাবেন, তাতে বন্ধুত্ব বাড়বে-সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়বে। শুধু পর্যটন ক্ষেত্র নয়, এর মাধ্যমে গোটা অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নও হবে।

বগুড়া চেম্বারস অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান মিলন বলেন, বগুড়া, নওগাঁ, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলে দেশীয় পর্যটকদের জন্য মোটামুটি সুবিধা রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে পর্যটক আনার জন্য যেসব উপকরণ প্রয়োজন সেগুলো এখনো এই অঞ্চলে গড়ে ওঠেনি। যেমন বগুড়ায় একটি বিমানবন্দর রয়েছে। এখানে দুটি ফ্লাইট প্রতিদিন চালু করা যেতে পারে। শুধু রানওয়েকে সম্প্রসারণ করলেই সেটি সম্ভব হবে। আর আন্তর্জাতিক পর্যটক আসা শুরু করলে তাদের চাহিদামতো আমরা হোটেল-মোটেলসহ অন্য বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে পারব।

উত্তরের জেলা নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধবিহার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আয়তনে এর সঙ্গে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা করা হয়। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। শুধু উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নয়, চীন, তিব্বত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। এ বিহারের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর প্রতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। এর গুরুত্ব বিচারে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি দেন।

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নওগাঁ থেকে প্রায় ৫৩ কিলোমিটার এবং জয়পুরহাট থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু উভয় জেলাতেই নেই কোনো ভালোমানের আবাসিক হোটেল। এবং ঢাকা থেকে একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম সড়কপথের বেহালদশা উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এই পর্যটনকেন্দ্রটি পর্যটক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ছাড়া পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারকে আকর্ষণীয় করতে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ ফলে ক্রমে শ্রীহীন হয়ে পড়ছে উপমহাদেশের প্রাচীনতম এ তীর্থস্থান।

এ ছাড়া নওগাঁতে রয়েছে- কুসুম্বা মসজিদ, বলিহার রাজবাড়ী, জবাই বিল, জগদ্দল বিহার, দিব্যক জয়স্তম্ভ, ভিমের পান্টি এবং মনোরম আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানসহ অনেক প্রাচীন স্থাপত্য ও পুরাকীর্তি।

বরেন্দ্র ভূমির রাজধানী হিসেবে খ্যাত রাজশাহী হতে পারত ভ্রমণপিপাসুদের একটি আদর্শ স্থান। এখানে রয়েছে দেশের প্রথম সংগ্রহশালা বরেন্দ্র জাদুঘর। এটি প্রত্ন সংগ্রহে সমৃদ্ধ। প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের দিক থেকে এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সংগ্রহশালা। বরেন্দ্র জাদুঘরের সংগ্রহ সংখ্যা ৯ হাজারেরও বেশি। এখানে হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে। মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত্ব, পাথরের মূর্তি, খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি, ভৈরবের মাথা, গঙ্গামূর্তিসহ অসংখ্য মূর্তি এই জাদুঘরের অমূল্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। মোগল আমলের রৌপ্য মুদ্রা, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে প্রায় পাঁচ হাজার পুঁথি রয়েছে যার মধ্যে ৩ হাজার ৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলো বাংলায় রচিত। কিন্তু প্রচারণা এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং ভালোমানের আবাসিক হোটেল-মোটেল তৈরি না হওয়ায় উপমহাদেশের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ এই জাদুঘরটিতে দর্শনার্থীর সংখ্যা দিন দিন শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রাজশাহীর পুটিয়া রাজবাড়ী, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম পুলিশ প্রশিক্ষণকেন্দ্র সারদা, রাজশাহীর সিল্ক পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারত।

উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র নামে পরিচিত বগুড়াকে ওই উত্তরের রাজধানী বলেই সবার কাছে জানা। একসময় মহাস্থানগড় বাংলারও রাজধানী ছিল। যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও আগে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেই তার প্রমাণ মেলেছে। ২০১৬ সালে এটি সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা হয়। এ ছাড়া মাজার শরিফ, কাঁটাবিহীন বরইয়ের গাছ, পরশুরামের প্রাসাদ ও প্রাচীর, গোবিন্দভিটা, মহাস্থানগড় জাদুঘর, বেহুলার বাসরঘর, শিলা দেবীর ঘাট, ভাসুবিহার সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু উত্তরের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রের মতো এটিরও নেই যথেষ্ট সংস্কার। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে রয়েছে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী।

এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ ও নওগাঁয় রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সেরা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ি। কিন্তু দেশের তিন কুঠিবাড়ির একটি শিলাইদহ (কুষ্টিয়া) পর্যটক টানতে পারলেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নওগাঁর পতিসর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর দর্শনার্থীশূন্য।

 
Electronic Paper