ঝুঁকিপূর্ণে ঠাঁই মেলেনি ‘শিশু গৃহকর্মী’
আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস
ছাইফুল ইসলাম মাছুম
🕐 ১০:৩০ অপরাহ্ণ, জুন ১১, ২০১৯
পত্রিকার পাতা খুললে চোখে পড়ে শিশু গৃহকর্মীদের প্রতি অমানবিক আচরণ, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, হত্যা কিংবা আত্মহত্যার মতো সংবাদ। সরকার শিশু শ্রমিকদের ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পেশার তালিকা করেছে। অথচ সেখানে ঠাঁই মেলেনি শিশু গৃহকর্মী পেশা।
শিশু অধিকারকর্মীরা বলছেন, শিশু গৃহকর্মীরা পরিবার থেকে বহুদূরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ওদের সোনালি শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে চার দেয়ালের মাঝে। অন্য শিশু শ্রমিকদের কাজের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা থাকলেও শিশু গৃহকর্মীদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। অন্যদের কাজের ক্ষেত্র দৃশ্যমান হলেও শিশু গৃহকর্মীদের কাজের ক্ষেত্র দৃশ্যমান নয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সিনিয়র প্রকল্প পরিচালক (শিশু নিরাপত্তা) রাফিজা শাহীন খোলা কাগজকে বলেন, ‘গৃহকর্মী শিশুকে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয় নাই। গবেষণা নয়, আমরা সাদা চোখেই দেখতে পারি, ওই কাজটি অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক শিশু জীবনও হারাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিশু আর শ্রম দুটো একসঙ্গে যায় না। কোনো ধরনের শিশুশ্রম থাকুক এটা আমরা চাই না।’
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানায়, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত এক লাখ শিশুকে শিশুশ্রম থেকে প্রত্যাহার করে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রদান করা হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পরিচালিত এক জরিপে (২০০৬) বাংলাদেশে শিশু গৃহকর্মীর সংখ্যা বলা হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার। এদের প্রায় ৮১ ভাগ মেয়েশিশু। জরিপে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীতে শিশু গৃহকর্মীর বড় অংশ কাজ করছে। তবে প্রায় এক দশক আগে পরিচালিত ওই জরিপে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। এমনকি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার সার্ভে ২০১৩-এও গৃহ শিশুশ্রম সম্পর্কে কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই।
২০১০ সালে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) ঢাকা মহানগরীতে একটি সমীক্ষা চালায়। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গৃহ শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগ মেয়েশিশু। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম কর্তৃক শিশু গৃহকর্মীদের পরিস্থিতি সম্পর্কে ১০টি শহরে ১২০০ শিশু গৃহকর্মীর ওপর পরিচালিত (ঢাকা ব্যতীত) গবেষণায় দেখা যায়, গৃহ শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের মধ্যে শতকরা ৮৩ ভাগ মেয়েশিশু। এক-তৃতীয়াংশ নিরক্ষর। শতকরা ৫০ ভাগ মাত্র ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। বেশির ভাগ শিশু পরিবারের দারিদ্র্যের কারণে শ্রমে নিযুক্ত হয়েছে। ১২ শতাংশ শিশু অভিভাবকহীন, ২৪ শতাংশের মা এবং ৮ শতাংশের বাবা আছে। ৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু কোনো বেতন পায় না কেবল খাবার, কাপড়-চোপড় ও থাকার বিনিময়ে কাজ করে। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের মাসিক গড় বেতন ১২৬৭ টাকা, তিন চতুর্থাংশ শিশুর বেতন অভিভাবক গ্রহণ করে (৪৪ শতাংশ মা এবং ১৯ শতাংশ বাবা)।
প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শিশু কাজ করার সময় আঘাতপ্রাপ্ত বা জখম হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। ৮০ শতাংশ শিশু ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করে। ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু শারীরিক এবং ৫৭ শতাংশ শিশু মানসিক শাস্তির কথা উল্লেখ করেছে। বয়স্কশিশুরা বেশি শাস্তি ভোগ করার কথা জানিয়েছে। প্রায় ৫০ ভাগ শিশু তাদের প্রতি খারাপ আচরণের কথা উল্লেখ করেছে। শতকরা ২০ ভাগ মেয়েশিশু যৌন হয়রানির (খারাপ ইঙ্গিত, কুপ্রস্তাব, শরীর স্পর্শ) কথা উল্লেখ করেছে। ৬১ শতাংশ ‘শিশু অধিকার’ সম্পর্কে কিছুই শোনেনি, যারা শুনেছে তারা টিভিতে বা বিদ্যালয়ে শুনেছে।
গৃহ শিশুকর্মীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ বলেন, ‘গৃহ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রকৃত সংখ্যা ও পরিস্থিতি জানার জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ কাজ পরিচালনা করা জরুরী। সরকার ঘোষিত শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের তালিকায় গৃহ শিশুশ্রম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫ পর্যালোচনা এবং এর সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করার জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল করিম খোলা কাগজকে বলেন, ‘যে সময় শিশুর স্কুলে যাওয়ার কথা, খেলার মাঠে থাকার কথা সে সময় শিশুরা অভাবের তাড়নায় গৃহকর্মীর কাজ করছে। তারা বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতনে শিকার হচ্ছে। যাদের সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ নেই তারাই শিশু গৃহকর্মীদের নির্যাতন করে। শিশু গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় সামাজিক সচেতনার বিকল্প নেই।’
আজ ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘শিশুশ্রম নয়, শিশুর জীবন হোক স্বপ্নময়’। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। আইএলওর তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে ১৫২ মিলিয়ন শিশু শিশুশ্রমে যুক্ত রয়েছে। প্রায় সব সেক্টরে শিশুশ্রম ঘটে।