উৎসবের আনন্দে যেন প্রাণহানি না হয়
জাকাতে সতর্কতা জরুরি
শফিক হাসান
🕐 ১১:০০ পূর্বাহ্ণ, মে ২৭, ২০১৯
জাকাত নিতে গিয়ে দুস্থরা লাশ হয়েছেন এমন নেতিবাচক সংবাদের দেখা মেলে কম-বেশি প্রায় প্রতিবছরই। এ নিয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, ধর্মীয় নেতারা সোচ্চার থাকলেও এখনো থামেনি এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা। অল্প কয়দিন পরই মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ঈদুল ফিতর।
এ উপলক্ষে ধনাঢ্য ব্যক্তি ও শিল্পপতিরা জাকাত দেবেন। সেই জাকাত দিতে গিয়ে নতুন করে কোনো হতভাগ্যের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ইতোমধ্যেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের সতর্কতার পরও কেন অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানি ঘটছে এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার এ উৎসবে প্রাণের সঙ্গে প্রাণ মিলবে, এক মাস সিয়াম সাধনার পর ধনীরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে নির্ধনের দুঃখ; কিন্তু শেষ প্রান্তে গিয়ে যে অব্যবস্থাপনার কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটে তাতে পুরো প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এ দায় এড়াতে পারে না সরকারও। অপ্রিয় হলেও সত্য, একটি শ্রেণি শুধু প্রচারের জন্য ‘প্রকাশ্যে’ জাকাত দেন। বিধিবিধান পালনের চেয়ে আনুষ্ঠানিকতাকেই বড় করে দেখানোর চেষ্টা করেন। যা ধর্ম এবং প্রচলিত আইন পরিপন্থী।
সমাজে সাম্য ও সম্পদের সুষম বণ্টনের বিধান হিসেবে চালু হয়েছে পবিত্র ইসলাম ধর্মের জাকাত প্রথা। ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী, ধনবান ব্যক্তিরা নির্ধন ও দুস্থদের নগদ অর্থসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী দেন। ইতোমধ্যে ‘জাকাতের কাপড়’ নামে আলাদা একটি কাপড়ের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। নিম্নমানের ও কম দামি কাপড় দিয়ে একটা শ্রেণি জাকাত ‘আদায়’ করেন। অন্যদিকে হতদরিদ্ররা অল্প কয়টা টাকা এবং কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ দেয়।
জাকাত নামের এ ‘মরণফাঁদে’ অনেক মানুষ পদদলিত হয়ে মারা গেলেও দায়ী জাকাতদাতাদের কখনোই আইনের মুখোমুখি করা হয়নি। আইনের ফাঁক গলে তারা বেরিয়ে এসেছেন বহাল তবিয়তেই। অন্যদিকে ‘ভুল থেকে শিক্ষা’ নিয়ে হলেও থামেনি জাকাত নিতে গিয়ে মৃত্যু। প্রদর্শনবাদিতার নিকৃষ্ট নজির এ জাকাত প্রদানকে শৃঙ্খলায় আনার যথাযথ উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।
জাকাতদাতার সংখ্যার তুলনায় গ্রহীতা অনেক বেশি। যে কারণে একটি শাড়ি নিতেও অনেক সময় নিজেরাই কাড়াকাড়ি শুরু করে। হুলুস্থ’ূলের কারণে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। কে কার আগে কাপড় নেবে এ প্রতিযোগিতায় ঝরে মূল্যবান প্রাণ। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান প্রচারমাধ্যমকে বলেন, ‘জাকাত নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু মর্মান্তিক। দরিদ্ররাই এমন মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। তাই যারা জাকাত দেয় তাদের আরও সতর্ক হতে হবে।’
এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে জাকাত দেওয়াটা উচিত। জাকাত দিতে হলে স্থানীয় পুলিশ অথবা সংশ্লিষ্ট এলাকার এসপিকে বিষয়টি আগে থেকে জানাতে হয়। তাহলে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু জাকাতদাতারা ঈদের আগ মুহূর্তে জাকাত দেন। এ সময় যে যত বেশি মানুষের সমাগম হয় তা থানার অল্পসংখ্যক পুলিশ দিয়ে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মনিরুজ্জামান আরও বলেন, শেষ মুহূর্তে পর্যাপ্ত পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়াও অসম্ভব। দাতারা আগে থেকে পুলিশকে অবহিত করলে নিরাপত্তা দেওয়া যায়। এবার যাতে কোনো অঘটন না ঘটে এ জন্য গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি থাকবে বলে জানান তিনি।
জাকাতদাতার জন্য কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামি চিন্তাবিদরা। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানিয়েছেনÑ ইসলামে দান সদকার বিষয়ে দুটি পথ খোলা রয়েছে। একটি প্রকাশ্যে অন্যটি গোপনে দান করা। প্রকাশ্যে দেওয়ার জন্য দাতার নিয়ত পরিষ্কার লাগবে। বড়ত্ব বা লোভ দেখানোর মানসিকতা থাকা অনুচিত।
সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে তারা অগ্রিম টোকেন প্রথার দিকে জোর দেওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন। দরিদ্র মানুষের ক্ষতি হয় এমন জাকাত না দেওয়াই উত্তম বলে মন্তব্য করেন ধর্মীয় নেতারা।
বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে জাকাতের কাপড় ও পণ্যসামগ্রী নিতে তিন শতাধিক মানুষ পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। এসব মৃত্যুতে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। জাকাতদাতারাও নিয়ম মানছেন না।
জানা যায়, ১৯৮০ সালে ঢাকার জুরাইনে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৮৩ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জাকাতের টাকা নিতে মৃত্যু হয় ৩ শিশুর। ১৯৮৭ সালের ২৩ মে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সরকারিভাবে দেওয়া জাকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে মৃত্যু হয় চারজনের। ১৯৮৯ সালের ৫ মে চাঁদপুরে জাকাতের কাপড় নিতে পদদলিত হয়ে ১৪ জন মারা যান। ১৯৯০ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আবুল বিড়ি ফ্যাক্টরিতে পদপিষ্ট হয়ে ৩৫ জন নিহত হন। আহত হন আরও দুই শতাধিক। ১৯৯১ সালের ১৩ এপ্রিল ঢাকার নবাবপুর রোডে দুজন মারা যান। ২০০৫ সালে গাইবান্ধার নাহিদ ফাউন্ডেশনে জাকাত নিতে গিয়ে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়। একই বছর চট্টগ্রামে কেএসআরএম মালিকের বাড়িতে জাকাত নিতে ৮ জন মারা যান। ২০১৪ সালের ২৫ জুলাই মানিকগঞ্জে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ হাসান রুনুর বাসায় তিনজনের মৃত্যু হয়। পরদিন বরিশালের খান অ্যান্ড সন্স গ্রুপের মালিকের বাসভবনে যাকাতে ২২ জনের মৃত্যু হয়। একই দিন বরিশালের কাঠপট্টি এলাকায় এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান দুই নারী। ২০১৫ সালের ১০ জুলাই ময়মনসিংহের অতুল চক্রবর্তী রোডে নূরানি জর্দা ফ্যাক্টরিতে পদপিষ্ট হয়ে ২৭ জনের মৃত্যু হয়।