প্রবাসে নারী শ্রমিক নিগ্রহ বন্ধে বাধা দালাল
জাফর আহমদ
🕐 ১১:০২ অপরাহ্ণ, মে ২৬, ২০১৯
প্রবাসে নারী শ্রমিক নিগ্রহের মূল কারণ ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ না থাকা ও অসচেতনতা। এ বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা থাকলেও তা কাজে আসছে না। দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে অনেকের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারী শ্রমিকরা যেভাবেই বিদেশে যাক, যাওয়ার আগে প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে নিয়োজিত সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করে গেলে নিগ্রহ ও সর্বস্ব হারানোর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে আদম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দালালরা সরকারি দফতর ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে তাদের দূরে রাখে। কেউ জানলেই ‘সোনার হরিণ’ হাতছাড়া হয়ে যাবে- এমন অবস্থা তৈরি করে দালালরা। টঙ্গীর পোশাক শ্রমিক জাহানারা খাতুন খোলা কাগজকে এ রকম একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। বিদেশে যাওয়ার আগে জাহানারা ছিলেন সিনিয়র অপারেটর। সব মিলিয়ে
প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেতেন। এ অবস্থায় এক দালালের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ওই দালাল তাকে বিদেশে একটি প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যানের চাকরির প্রলোভন দেখান। বেশি বেতন, ভালো থাকা-খাওয়া এবং কয়েক বছর চাকরি করে সারা জীবন বসে খাওয়া যাবে- এমন সব স্বপ্ন দেখায় সেই দালাল। এর ফলে পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান জাহানারা। ছয় মাস পর বাড়ির লোকজন জানতে পারেন, জাহানারাকে বাথরুম ও ঘর-দোর পরিষ্কার এবং শিশুদের লালন পালনের কাজ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য সামসুন্নাহার ভূঁইয়া খোলা কাগজকে বলেন, মেয়েটি বিদেশে যাওয়ার সময় বলেছিল মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে। কিন্তু তাকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়। দালালরা এমনভাবে মেয়েটিকে বুঝিয়েছিল যে, সে তার বাবা-মাকেও ভুল বোঝায়।
তিনি বলেন, যে মেয়েটি দেশে একটি কারখানায় সম্মানের সঙ্গে কাজ করত, বিদেশে গিয়ে দুর্বিষহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার পরই সে তার ভুল বুঝতে পারল। দেশেও ফিরে আসতে হয়েছে। বিদেশে যাওয়ার আগে চঞ্চল ফুলের মতো যে মেয়েটিকে দেখেছিলাম, বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর মেয়েটি আর নেই। তার শরীর ভেঙে পড়েছে। মনজুড়ে হতাশা। সমাজের মানুষ সবাই তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। অথচ দালালদের খপ্পরে পড়ায় বিদেশে যাওয়ার প্রলোভনে কারো সঙ্গে সেসময় পরামর্শ করেনি জাহানারা।
গত ১০ বছরে বিদেশে প্রায় ৮ লাখ নারী শ্রমিক গেছে। পার্লামেন্টারিয়ান ককাস অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এ সম্পর্কিত এক কর্মশালায় উঠে আসে এসব নারী শ্রমিকের মধ্যে যেসব নারী সরকারিভাবে বা বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে গেছে সেসব শ্রমিক ভালো আছেন। তারা দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। তাদের বিদেশে যাওয়ার সময় টাকাও লেগেছে কম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনোই টাকা লাগেনি। পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ এবং সেদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা। ফলে তারা নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু দালালদের মাধ্যমে যাওয়া নারী শ্রমিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে না বোঝার কারণে অবহেলার শিকার হয়েছে। কোনো কোনো নারী শ্রমিক যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছে, নিঃস্ব হয়েছে।
এ বিষয়ে পার্লামেন্টারিয়ান ককাস অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সভাপতি ইসরাফিল আলম বলেন, যেসব শ্রমিক দালালদের প্ররোচনায় অবৈধ পথে বিদেশে যান তারা একই সঙ্গে তিন ধরনের ক্ষতি করছেন। প্রথমত, বেশি টাকা দিয়ে যাচ্ছেন; দ্বিতীয়ত, নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন; তৃতীয়ত, অবৈধভাবে যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তারা তাদের রোজগারের টাকা পাঠাচ্ছেন অবৈধ পথে। এতে দেশের কোনো লাভ হচ্ছে না।
ইসরাফিল আলম বলেন, দালালদের খপ্পরে পড়ে যাতে কোনো মানুষ দেশের বাইরে গিয়ে বিপদে না পড়েন সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। নারী শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে যাতে সম্মান পান, নিগ্রহের শিকার না হন সেজন্য গৃহ শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়ার জন্য নীতিমালা করা হয়েছে। অবৈধ পথে যাতে টাকা না পাঠায় এ জন্য বৈধপথে টাকা পাঠানোর জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করছি বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা অবৈধ পথ পরিহার করবেন।