বোরোতে গচ্চা ২৩ হাজার কোটি টাকা
নাজমুল হুসাইন
🕐 ১০:৫৬ অপরাহ্ণ, মে ২৬, ২০১৯
বোরোর বাম্পার ফলনের পরও এবার কৃষকের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। ধানের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় কৃষকের গচ্চা দিতে হচ্ছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। আর এর পুরো টাকাই যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী, ফড়িয়া, চালকল মালিকদের পকেটে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতি মণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকায়। কোনো কোনো এলাকায় এ থেকেও কম। অর্থাৎ কেজিপ্রতি ধানের সর্বোচ্চ গড় দাম উঠেছে ১৪ টাকা। যদিও সরকারি হিসাবে এ বছর কমপক্ষে ২৬ টাকা দরে বোরো ধান বিক্রি করতে পারলে দেশের কৃষকরা মুনাফার মুখ দেখতেন। অর্থাৎ এ অবস্থায় প্রতি কেজি ধানে কৃষকের গচ্চা ১২ টাকা।
এদিকে ২৬ টাকা দর হিসেবে কৃষকের কাছে ধান কিনছে সরকার। তবে সরকার যতটা ধান কিনছে তা উৎপাদনের তুলনায় খুবই নগণ্য। ফলে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে কম দামে বাজারে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। আর বাজারে ধান বিক্রি করলে কৃষকের লোকসান গুনতে হচ্ছে কেজিতে ১২ টাকা হিসাবে মণপ্রতি ৪৮০ টাকা।
এবার হিসাব-নিকাশ বলছে, এ মৌসুমে বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। আর সরকারের কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ফলন হয়েছে এ বছর। যাই হোক, লক্ষ্যমাত্রা ধরেই হিসাব করলেও এ বছর ১ কোটি ৯৬ লাখ টন অর্থাৎ ১ হাজার ৯৬০ কোটি কেজি ধানে কৃষকের লোকসান হবে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
কৃষকের এ বিপুল অর্থ মুনাফা হিসেবে যাবে চালকল মালিক এবং চালের অন্যান্য স্তরের ব্যবসায়ীদের পকেটে। কারণ দেশে ধানের দাম যতই কম হোক না কেন সাধারণ মানুষ কম দামে চাল খেতে পারবেন না। তাদের ঠিকই চড়া মূল্য গুনতে হবে।
অন্যদিকে সরকারের ধান-চাল কেনার নীতির কারণেও পোয়াবারো হচ্ছেন মিল মালিক, ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। কৃষকের কাছ থেকে নামমাত্র ধান কিনলেও পরবর্তীতে সেই ধানই চালে রূপান্তর করে সরকারের কাছে বেচবেন তারা। এবারেও কিছুদিন পর থেকে ১০ লাখ টন চাল কেনা শুরু হবে, যেখানে কৃষকের ধান কেনা হচ্ছে মাত্র দেড় লাখ টন। আর দেশের কৃষকের ধানকে চালে রূপান্তরের সক্ষমতা নেই, ফলে সে সুযোগ নেবেন ব্যবসায়ীরাই।
ধান-চাল কেনার সুফল কৃষক পায় না এবং এ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ বলে জানিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্মানীত ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান খোলা কাগজকে বলেন, ‘সরকার মুখে বললেও ধান-চাল সংগ্রহের কার্যক্রম কৃষকের জন্য সুফল আনতে পারছে না। বাস্তবে কার স্বার্থে এ কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে, সেটা কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায়। এটা কোনোভাবেই কৃষকবান্ধব নয় বরং ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার কৌশল মাত্র। আর প্রতিবছর তাদের দেখানো পথেই হাঁটছে সরকার। এতে এ সুবিধা অপব্যবহার করে কৃষকের মুনাফার অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।’
তথ্য বলছে, সরকারের হিসাবে এবার চাল উৎপাদনে ৩৪ টাকা খরচ হচ্ছে। আর ধানে ২৪ টাকা। কিন্তু বাজার থেকে ধান কেনা যাচ্ছে ১৪ টাকা দরে। সেটা এখন চালে রূপান্তর করলে এর দাম দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১৮ টাকা। আর অন্যান্য সব খরচ মিলে সর্বোচ্চ ২০ টাকা। অর্থাৎ সেই চাল সরকারি গুদামে দিতে পারলে প্রতি কেজিতে মুনাফা হবে প্রায় ১৬ টাকা। অন্যদিকে বাজারে কোথাও এ চাল এত কম দামে কিনতে পারবে না সাধারণ মানুষ। সরকার নেওয়ার পরে বোরোর বাকি প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টন চাল সাধারণ মানুষকে কিনতে হবে কমপক্ষে ৪০ টাকা দরে। তাতে প্রতি কেজিতে দামের ব্যবধান থাকবে ২০ টাকা। এভাবে কৃষকের নায্য পাওনা ভোক্তারা গুনলেও সেটা যাবে ব্যবসায়ীদের পকেটেই।