ভারতে ফের নরেন্দ্র মোদি সরকার
প্রত্যাশা ন্যায্য হিস্যার
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০০ অপরাহ্ণ, মে ২৪, ২০১৯
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) টানা দ্বিতীয়বারের মতো জয় পেয়েছে। দলটির ভূমিধস বিজয় বাংলাদেশের জন্য কতটা স্বস্তির হলো- সেই হিসাব কষতে শুরু করেছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় দলটির জয় কতটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সে অঙ্কই মেলানোর চেষ্টা চলছে। পুনরায় ক্ষমতায় আসায় এরই মধ্যে বিজেপিকে অভিনন্দন জানিয়েছে ক্ষমতসীন আওয়ামী লীগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা আশা করছেন, ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে এবং তিস্তার পানি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ ও কানেকটিভিটির সার্বিক বিষয়ে আরও অগ্রগতি হবে। গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষমতাসীন বিজেপির বিশাল জয়ের পর বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিসহ অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, মোদি সরকারের গত আমলে আমাদের সঙ্গে অনেক অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান হয়েছে। মোদি সরকারের সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দুদেশের সীমান্ত সমস্যার সমাধান। এবার নরেন্দ্র মোদি তার দেশের জনগণের আস্থা আরও বেশি করে পেয়েছেন। আমরা আশা করি, আমাদের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানের যে প্রক্রিয়াটা আছে, সেটা আরও দ্রুত হবে।’
দুদেশের বাণিজ্যিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারসাম্যহীনতা কিছুটা কেটে যাবে- এমনটা আশা করা হলেও রাজনীতি ও সামাজিক পরিবেশে অস্থিরতার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষী নীতি ও বক্তব্য মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নতুনভাবে উসকে দেওয়ার পথ তৈরি করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতে বিজেপি দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা ভারতের প্রদেশগুলোতে গত কয়েকটি নির্বাচনে বিজেপি ভালো ফল করেছে। ফলে দেশটির অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থি রাজনীতির উত্থান বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আসামে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে বিজেপি সরকারের অবস্থান, নানা উসকানিমূলক ও সাম্প্রদায়িক বক্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সামাজিক স্থিতিশীলতাকে টলায়মান করে তুলেছিল। তারা বলেছিল আসামে যে ৪০ লাখ মানুষ ‘অবৈধভাবে’ বসবাস করছে তারা বাংলাদেশি এবং তাদের বেশির ভাগ মুসলমান। তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এবারের নির্বাচনের প্রচারণার সময় বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আসামের মতো ‘নাগরিকত্ব যাচাইয়ের’ কাজ তারা পশ্চিমবঙ্গেও করতে চায়। বিজেপি নিজেদের হীন ও ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’-এর বিরুদ্ধে যেসব স্লোগান ব্যবহার করেছে সেটা চলমান থাকলে বাংলাদেশের মানুষও ক্ষুব্ধ হবে। দেশের অভ্যন্তরে মানুষের এ মনোভাবকে পাশ কাটানোর কোনো সুযোগ থাকবে না সরকারের। যদিও সরকার কখনো চাইবে না ভারতের সঙ্গে কোথাও সম্পর্কের অবনতি ঘটুক। বাংলাদেশে সরকারের এ মনোভাব সর্বপ্রথম বুঝতে হবে বিজেপি বা মোদি সরকারকে। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা যদি মুসলিমবিরোধী কথাবার্তা জোরালো করে, তাহলে সে বিষয়টি বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করে দেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, বহু বছর ধরে উপমহাদেশে ভারতের পরিচিতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির’ একটি মডেল হিসেবে। কিন্তু বিজেপির উত্থান ভারতের সে পরিচিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পরপর দুটো নির্বাচনে বিজেপির জয় বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনীতি যারা করতে চায়, তাদের চিন্তায় ফেলবে।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার চাইবে ভারত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার। কিন্তু ভবিষ্যতে সে সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, সেটি নিভর করছে বিজেপি সরকারের মনোভাবের ওপর। ভারতে যদি সেক্যুলার রাজনীতি না চলে এবং তারা যদি আমাদের চারদিকে বিদ্বেষের রাজনীতি নির্বাচনে জেতার জন্য আরম্ভ করে দেন, তখন সরকারের পক্ষে সে জিনিসটা ম্যানেজ করা আরও অসুবিধা হবে।
‘ক্যারিশমা কিং’ মোদির কাছে বাংলাদেশের কী কী পাওয়ার আছে বা বাংলাদেশ কী প্রত্যাশা করতে পারে-এমন নানা বিষয়ের তালিকা করছেন অনেকে। এর মধ্যে তিস্তাচুক্তি, বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্য আনয়ন, ট্রানজিটের বিপরীতে যথাযথ বিনিময় প্রদানসহ নানা ইস্যু উঠে আসছে। দুদেশের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক সুসংহত করতে হলে এসব বিষয়ে প্রাধান্য দিতে হবে মোদি সরকারকে। এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিবেশী হিসেবে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপি- দুই দলের সরকারকে পেয়েছে। দুই দলই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুদলের আমলে কোনো হেরফের হয়নি। এ সময়ের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়, সড়কপথে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে সাধারণ মানুষের আসা যাওয়া ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ও বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার পর তিস্তা চুক্তির দিকে তাকিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। সড়কপথে ট্রানজিট দেওয়ার পর ভারতের কাছে বাংলাদেশের তিস্তাচুক্তি দাবি ন্যায্য এবং মানবিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের আপত্তির কারণে মোদি বা বিজেপি সরকার তিস্তাচুক্তি নিয়ে এগুতে পারছে না। তবে পশ্চিমবঙ্গের মমতার দুর্গে বিজেপি এবার যে বিক্রমোচিত ফল করেছে তাতে তাদের ক্ষমতা যেমন বেড়েছে তেমনি তৃণমূলের শক্তিও কিছুটা পড়ে গেছে। এতে তিস্তাচুক্তির পক্ষে তৃণমূল সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বিজেপি পর্যাপ্ত শক্তি পাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও আঞ্চলিক স্বার্থের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক বা বিজেপির সমর্থকরা কোনো ছাড় দেবে কি না সে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন, বাংলাদেশের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো, যেমন বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানো। গত মেয়াদে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার কথা বললেও মোদি সরকার ততটা অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। তবে নতুন দফায় আশা করি, সেদিকটায় অগ্রগতি হবে। এক দশকে নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের যেসব উদ্বেগের জায়গা ছিল, বাংলাদেশ সেসব ইস্যু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করেছে, সেটা দুই দেশের সম্পর্কে আস্থা বাড়িয়েছে। তবে সে আস্থা আর সুসম্পর্ক থেকে উভ দেশই লাভবান হচ্ছে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে দুই দেশকে।
সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, নিরাপত্তার ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগকে বাংলাদেশ যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে ভারত সেভাবে বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয়নি। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের মতো বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়াটা বাংলাদেশকে মর্মাহত করেছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এখনো কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে ভারতের-এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা। সেই সঙ্গে
তিস্তাসহ বেশ কয়েকটি নদীর পানি বণ্টনসহ দুই দেশের মধ্যে যে কটি অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে সে ব্যাপারে ভারত বা মোদি সরকার এবার মনোযোগী হবে-এমনটা সরকারের সংশ্লিষ্টদেরও আশা। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৪ লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতির (২০১৩ সাল থেকে ২০১৮) বিষয়টিও দেখতে হবে মোদিকে। বিনিময়ে ভারসাম্য না থাকলে বন্ধুত্ব বা কূটনেতিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যেতে পারে বলে আশংকা অনেকের।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারত বাংলাদেশকে যে লাইন অব ক্রেডিট দেয়, সেটা ছাড় করায় দীর্ঘসূত্রতা থাকে, প্রকল্প পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। আবার এর শর্ত থাকে তাদের দেশ থেকে কাঁচামাল কিনতে হবে, সেটা অনেক সময় আমাদের জন্য সুবিধাজনক হয় না। এর বাইরে দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতিও অনেক। এসব বিষয় আগের মেয়াদে কোনো সমাধান আসেনি, এবার মোদি সরকার সে বিষয়ে নজর দেবে-সেটাই হবে বাংলাদেশের প্রত্যাশা।