৫২ ভেজাল পণ্য প্রত্যাহারের নির্দেশ হাইকোর্টের
জনস্বাস্থ্য ক্ষতির দায় কার
সুলতান মাহমুদ
🕐 ১১:০০ অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০১৯
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় নিম্নমান ও ভেজাল প্রমাণিত হওয়ায় সম্প্রতি ৫২টি খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এসব খাদ্যপণ্য বিক্রি ও সরবরাহে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের প্রতি নির্দেশও দেওয়া হয়।
জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ১২ মে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদেশে বলা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই ৫২ পণ্য বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় পুনরায় উত্তীর্ণ না হচ্ছে, ততক্ষণ এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে মাদকবিরোধী অভিযানের মতো খাদ্যে ভেজাল মেশানোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
এদিকে উচ্চ আদালতের এ রায়ের পর ভেজাল ও নিম্নমানের ওই ৫২টি পণ্যের তালিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব পণ্য না কেনার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত আহ্বান করেন অনেকে। নানামুখী প্রশ্নও ওঠে। নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ দেখা দেয় জনমনে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব পণ্য বাজারে এতদিন ধরে কীভাবে বহাল তবিয়তে চলল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দিনের পর দিন এসব ভেজাল খাবার খেয়ে ভোক্তাদের যে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে তার দায়ভার আসলে কার। এ ছাড়া নামি-দামি ব্রান্ডের ভোগ্যপণ্যে যে ভেজাল ও নিম্নমানের উপকরণ মেশানো হয়েছে তাতে ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা ও সততা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভোক্তাদের বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে যে চরম প্রতারণা করা হলো তার দায়ভারটা কে নেবে।
উচ্চ আদালতের রায়ের পর কিছু প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে ভেজাল পণ্য তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই এসব পণ্য এখনো সরিয়ে নেয়নি। তদারকি সংস্থা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন শুরুর জন্য আরও দুই-তিন দিন সময় লাগবে। এদিকে গতকাল বুধবার নিম্নমানের পণ্য হিসেবে চিহ্নিত ৫২টি খাদ্যপণ্যের মধ্যে সাতটির উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করেছে। লাইসেন্স বাতিল হওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকায় ড্রিংকিং ওয়াটারের মধ্যে আল সাফি ড্রিংকিং ওয়াটার, শাহারী অ্যান্ড ব্রাদার্স, মর্ন ডিউ পিওর ড্রিংকিং ওয়াটার; সফট ড্রিংকের মধ্যে শান্তা ফুড প্রডাক্ট, জাহাঙ্গীর ফুড প্রডাক্টস এবং ঘি এর মধ্যে বনলতা সুইটস অ্যান্ড বেকারি রয়েছে।
লাইসেন্স স্থগিত হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সরিষার তেলে সিটি অয়েল মিল-গাজীপুর (তীর), গ্রিন ব্লিসিং ভেজিটেবল অয়েল-নারায়ণগঞ্জ (জিবি), শবনম ভেজিটেবল অয়েল-নারায়ণগঞ্জ (পুষ্টি), বাংলাদেশ এডিবল অয়েল-নারায়ণগঞ্জ (রূপচাঁদা); সুপেয় পানির মধ্যে আররা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ (আররা), ডানকান প্রডাক্ট (ডানকান), দীঘি ড্রিংকিং ওয়াটার (দীঘি); প্রাণ এগ্রো লিমিটেডের প্রাণ ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাই; হলুদের গুঁড়ার মধ্যে ড্যানিশ, প্রাণ ও ফ্রেশ। কারী পাউডারের মধ্যে প্রাণ ও ড্যানিশ; আয়োডিনযুক্ত লবণের মধ্যে এসিআই ও মোল্লা সল্ট; ধনিয়া গুঁড়ার মধ্যে এসিআই পিওর, নুডলসের মধ্যে নিউজিল্যান্ড ডেইরির নুডল্স এবং চিপসের মধ্যে কাশেম ফুডের সান ব্র্যান্ড রয়েছে। মনোন্নয়ন করে আবার লাইসেন্স গ্রহণের আগে এসব পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ এমনকি খুচরা বিক্রি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এসব পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি এর সংরক্ষণ ও বাণিজ্যিক প্রচার বন্ধ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিএসটিআই সম্প্রতি বাজারে গোপন অভিযান চালিয়ে ৪০৬টি পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেছিল। এসব পণ্যের মধ্যে ৫২টি পণ্য নিম্নমানের হিসেবে চিহ্নিত হয় ল্যাবরেটরি পরীক্ষায়। এ পণ্যগুলোর মধ্যে প্যাকেটজাত লবণ, তেল, হলুদ, লাচ্ছা সেমাই ও বোতলজাত পানি রয়েছে।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, প্যাকেটজাত লবণে যে পরিমাণ আয়োডিন মেশানোর কথা তার চেয়ে অনেক কম ছিল। বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ আয়োডিন ঘাটতিতে ভোগে। এ ঘাটতি মেটাতে সরকার প্যাকেটজাত লবণে আয়োডিন মেশানো বাধ্যতামূলক করে। এ জন্য আড়াইশ লবণের ফ্যাক্টরিকে আয়োডিন মেশানোর মেশিন দেওয়া হয়। কিন্তু লবণ উৎপাদনকারীরা বেশির ভাগই এ নিয়ম না মেনে ট্যাংকের ভেতর পানির সঙ্গে গুলিয়ে আয়োডিন দেয়। এতে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় আয়োডিন থাকে না।
হলুদ, মরিচসহ বিভিন্ন মসলার গুঁড়ায় চকচকে দেখানোর জন্য কৃত্রিম রং মেশানো হয়। এর আগে কোনো কোনো মসলায় সিসার অস্তিত্বও পাওয়া গেছে। লাচ্ছা সেমাইয়ে পাওয়া গেছে অনুমোদিত মাত্রার চেয়েও বেশি তেল ও চর্বি জাতীয় পদার্থ। বোতলজাত পানিতে পাওয়া গেছে অণুজীব। এ ছাড়া সরিষার তেলে মিলেছে আয়রন। এ ছাড়া কেমিকেল মিশিয়ে ঝাঁঝালো করা হয়েছে তেল।
চিকিৎসকরা বলছেন, দিনের পর এসব নিম্নমানের ও ভেজাল খাদ্য ক্যান্সার থেকে শুরু কিডনির অসুখ, হার্টের অসুখসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। আয়োডিনের ঘাটতির কারণে শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক গড়নে প্রভাব পড়ে। তাই এসব পণ্য না খাওয়া উচিত। ভোক্তা অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশে এখনো নিরাপদ খাদ্যের ধারণাটি জনগণের মাঝে পৌঁছেনি। তদারকি সংস্থাগুলোও শক্তিশালী নয়। সমন্বয়ও নেই সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাঝে। ভোক্তা অধিকার আন্দোলন এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই অনৈতিক ও অসৎ ব্যবসায়ীরা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। বাজারে ছাড়ার আগে পণ্যের মান পরীক্ষায় উতরে গেলেও বাজারে গিয়েই ভেজাল ছাড়ছে। আর আইনবিদরা এ বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন আর তার দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছেন।