ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

স্ত্রী জাবিনের দাবি

যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী হওয়ায় সুমন খুন

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৪২ অপরাহ্ণ, জুন ১৯, ২০১৮

একাত্তরে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদকে হত্যা করা হয়েছে বলেই মনে করেন সুমনের স্ত্রী কাজী রাফিনা জাবিন। কারণ যুদ্ধাপরাধ মামলায় সুমন সাক্ষ্য দেওয়ার পর থেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল পুরো পরিবার। যারা বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়ে আসছিল তারাই সুমনকে হত্যা করেছে বলে সন্দেহ করছেন তিনি।

সুমন জাহিদ শুধু যুদ্ধাপরাধ মামলার সাক্ষীই ছিলেন না, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সর্বত্র সোচ্চার একজন কর্মী ছিলেন। একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মীও।
সুমন জাহিদকে যুদ্ধাপরাধী চক্রের সন্ত্রাসী বা সমর্থক দুর্বৃত্তরাই হত্যা করেছে- এ সন্দেহ ঘনীভূত হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণও তুলে ধরেছেন সুমনের স্ত্রী, পরিবারের অন্যান্য লোকজন, বন্ধু ও স্বজনরা। স্ত্রী জেবিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোটভাই মিরাজকে যারা হত্যা করেছিল সেই একই দুর্বৃত্তরাই হত্যা করে থাকতে পারে সুমনকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার অপরাধে বেশ কয়েকবারই বুলবুল হুমকি পেয়েছেন। তাকে হত্যা করতে না পেরে দুর্বৃত্তরা ২০১৩ সালের মার্চে তার ভাই মিরাজকে শ্বাসরোধে হত্যা করে রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের পাশ ফেলে রেখে গিয়েছিল। বুলবুল ও সুমন একই মামলার সাক্ষী। সুমনকেও দীর্ঘদিন ধরে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে দুর্বৃত্তরা। পুলিশকে বেশ কয়েকবার বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। জিডিও দায়ের হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তার নিরাপত্তার ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন ছিল। নিরাপত্তা চাইতে গেলে পুলিশ সুমনকে বলেছিল- একটা পিস্তল কিনে নিয়ে ব্যবহার করতে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাগিচা এলাকার রেললাইনের পাশে সুমন জাহিদের খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্থানীয় এক শিশু প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে পুলিশ দাবি করেছে- সুমন নিজেই রেললাইনে মাথা দিয়েছিলেন। কয়েকটি গণমাধ্যমও ওই শিশুর বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করে। সুমনের পরিবারের লোকজন অনুরোধ করেছে- পুলিশ ও শিশুর বরাত দিয়ে বিভ্রান্তিকর খবর যেন কেউ প্রকাশ না করেন। কারণ সুমন জাহিদের মৃত্যুর ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্যই দুর্বৃত্তরা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। আত্মহত্যা করার মতো কোনো বাস্তব পরিস্থিতি যেমন তৈরি হয়নি, তেমনি সুমন জাহিদ কোনো কিছুতে হতাশ হয়ে, ভেঙে পড়ে আত্মহত্যা করার মতো দুর্বল মানসিকতার মানুষই ছিলেন না।
স্ত্রী জেবিন বলেন, ট্রাইব্যুনালে মামলার সাক্ষী হওয়ার পর থেকেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম। একটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কাজ করত সবসময়। জীবনটা শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে গিয়েছিল। তারপরও কখনো ভেঙে পড়েননি সুমন। মানসিকভাবে খুব শক্তিশালী ছিলেন। আমরা সবসময় তাকে নিয়ে উদ্বেগে থাকতাম-কখন কী হয়ে যায়। আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। ট্রাইব্যুনালে মামলার সাক্ষ্য দেওয়ার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
সুমনের স্ত্রী জাবিনের বড় ভাই কাজী মোহাম্মদ বখতিয়ারও একই কথা বলছেন। তিনি বলেছেন পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে মৃত্যুর আগে সুমন জাহিদ চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলেন। অথচ সুমন চা পান করতেন না। তাহলে কারা দেখলেন সুমন চা খাচ্ছেন? প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বলা হয়েছে, সুমন নাকি বেশ কয়েক দিন ওই এলাকায় ঘুরাফেরা করতেন আর মনমরা হয়ে বসে থাকতেন। এটাও অসম্ভব। কারণ ওই এলাকায় সুমনের যাতায়াতের কোনো কারণই নেই। কথিত প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের বক্তব্যে অসঙ্গতি রয়েছে দাবি করে বখতিয়ার বলেন, এটা আত্মহত্যা নয়। সুমন আত্মহত্যা করতে পারে, সেটা আমরা কিছুতেই মানতে পারছি না। এ মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। সুমন যে মামলার সাক্ষী সে মামলার আরেক সাক্ষী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাইকেও হত্যা করা হয়েছে। সুমনকেও হত্যা করে এখন কেউ আত্মহত্যার কথা বলছে।
সুমন জাহিদ ফারমার্স ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার কর্মকর্তা ছিলেন। শাখাটিতে আত্মীয়-স্বজনের টাকা বিনিয়োগ করিয়েছিলেন তিনি। কয়েক মাস আগে শাখাটি বন্ধ হয়ে গেছে এবং তার চাকরিও নেই। এসব ঘটনা তার মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে কি না-আর হতাশার কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন কি না-বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে রেল পুলিশ।
অবশ্য স্ত্রী জাবিন বলছেন, ফারমার্স ব্যাংকে সুমনের কথায় পরিচিত অনেক লোক টাকা-পয়সা জমা রেখেছিল। শাখাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাদের অনেকে প্রায়ই টাকাগুলো তুলে দেওয়ার জন্য বলত; তবে এজন্য বিশেষ চাপ কেউ দিত না। ফলে এজন্য সুমন আত্মহত্যা করেছে বললে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
সুমনের শ্যালক সরোয়ার বলেন, সুমন ভাই আর্থিক অনটনে ছিলেন না যে চাকরি না থাকায় তাকে আত্মহত্যা করতে হবে। তা ছাড়া ব্যাংকের চাকরি চলে যাওয়ার পর তো তার আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যোগদানের কথাবার্তা চলছিল। ঘরের সবার সঙ্গেও ছিল ভালো সম্পর্ক।
এর আগে গত শুক্রবার স্ত্রী জাবিনের বরাত দিয়ে সুমন জাহিদের ভায়রা এমদাদুল হক বুলবুল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওইদিন (১৪ জুন) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কে বা কারা উত্তর শাজাহানপুরের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায় সুমনকে। তার আধাঘণ্টা পরেই বাগিচার রেললাইনের পাশে তার লাশ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘এটা স্পষ্ট যে জাহিদকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
ঘটনার বিষয়ে তদন্তের অগ্রগতি কী জানতে চাইলে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াসিন ফারুক বলেন, ঘটনাস্থলে থাকা এক প্রত্যক্ষদর্শী শিশু পুলিশের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেছে রেলে কাটা পড়ে সুমনের মৃত্যু হয়েছে। এ সাক্ষ্য ছাড়াও এ মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্ত চলছে।

 
Electronic Paper