ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নিউজিল্যান্ড-লঙ্কার পর কে

সন্ত্রাসকাণ্ডে উদ্বিগ্ন বিশ্ব

রহমান মুফিজ
🕐 ১১:১৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৩, ২০১৯

মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় ও বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্ব এবং উগ্রবাদ। এসব উগ্রতা ক্রমাগত সন্ত্রাসবাদী চরিত্র ধারণ করছে। সারা বিশ্বে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে মানবসভ্যতাকে। গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা হতবাক করে দিয়েছিল বিশ্বকে। ৪৯ ধর্মপ্রাণ মুসলমান সন্ত্রাসীদের গুলিতে সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল। সে ঘটনার শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই গত রোববার শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে কয়েকটি খ্রিস্টান চার্চ ও হোটেলে ইতিহাসের ভয়াবহতম সিরিজ বোমা হামলা সংঘটিত হয়েছে।

সরকারি হিসাবে গতকাল পর্যন্ত এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৩২১ জন। আহত হয়েছে ৫শ’রও বেশি মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-আইএস এ হামলার দায় স্বীকার করে বার্তা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রাভন বিজয়াবর্ধনে পার্লামেন্টে এক বিবৃতিতে বলেছেন, নিউজিল্যান্ডের মসজিদে চালানো হামলার প্রতিশোধ হিসেবে শ্রীলঙ্কার গির্জায় এ হামলা করা হয়েছে।

উগ্রবাদীদের পাল্টাপাল্টি এসব সন্ত্রাসকাণ্ডে উদ্বিগ্ন গোটা বিশ্ব। নিউজিল্যান্ড-শ্রীলঙ্কার ঘটনার পর এবার কে বা কারা উগ্রবাদীদের টার্গেটে রয়েছে, তা-ই ভাবাচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উগ্রবাদের খোলসে সন্ত্রাসবাদ নতুন রূপ ধারণ করেছে। জাতিতে, ধর্মে, বর্ণে এবং সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্প্রীতির আদি সংস্কৃতিকে নস্যাৎ করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সর্বত্র উসকে দিচ্ছে ঘৃণাকে। মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতার বীজ ছড়িয়ে দিয়ে উগ্রবাদের জন্ম দেওয়া হচ্ছে দিন দিন। সেই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদকে স্পষ্টতই রাজনৈতিক সহিংসতা বলেও আখ্যা দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে ঐতিহাসিকভাবে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে উগ্রবাদের সম্পর্ক রয়েছে। তবে সব সন্ত্রাসীই উগ্রবাদী নয় আবার সব উগ্রবাদীই সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা প্রমাণ করছে উগ্রবাদ মানেই সন্ত্রাসবাদ। জোর করে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতবাদ অপরের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে উগ্রবাদ বিস্তৃত হচ্ছে। অথচ শীতল যুদ্ধের সময়েও উগ্র মতবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল গোটা বিশ্ব।

অনেকে মনে করেছিলেন, বার্লিন ওয়ালের পতনের পর কথিত ‘ইজম’-এর দাপট শেষ হয়ে বিশ্ব মানবতা মানবিক অর্থে একটি অভিন্ন পতাকার তলে দাঁড়াবে। কিন্তু সেটি ঘটেনি। আফগানিস্তানকে সোভিয়েট দখলমুক্ত করার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে উগ্র ধর্মান্ধ ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে গোটা আফগান জাতিকে তুলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে উগ্রবাদ জায়গা পেলেও আফগানিস্তানের তালেবানী শাসনের করায়ত্ত হওয়ার পর থেকে ধর্মীয় মতবাদকে ভিত্তি করেই পৃথিবীতে উগ্রবাদ ডানা ছড়িয়েছে।

২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে আল কায়েদার বিমান হামলার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ বিশ্বব্যাপী নতুন চেহারা পায় এবং আল কায়েদার তথাকথিত ‘জিহাদের’ বিপরীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিশ্বব্যাপী ‘ক্রুসেড’ ঘোষণা করে। মূলত নাইন ইলেভেন-পরবর্তী বিশ্ব ধর্মীয় উগ্রবাদী ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসীদের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে; যার ভয়াবহতার শিকার হতে হয়েছে বিশ্বের সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষকে।

এ বছরের শুরুতেই ১১ জানুয়ারি পাকিস্তানের শিয়া অধ্যুষিত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কোয়েটায় দুটি স্থানে আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা যায় শতাধিক মানুষ। পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সুন্নি চরমপন্থি দল লস্কর-এ-জংভি ওই হামলার দায় স্বীকার করে। কোয়েটায় বোমা হামলার ঘটনার আগের দিন উত্তর-পশ্চিমের সোয়াত প্রদেশের মিনগোরা শহরে এক ধর্মীয় নেতার জনসভায় বোমা হামলার ঘটনায় অন্তত ২১ জন নিহত হয়। পরের মাস ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখেও কোয়েটার একটি জনবহুল বাজারে বোমা হামলা করে ৬৩ জনকে হত্যা করে লস্কর-এ-জংভি।

এ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে গত চার মাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ২৬৪টি সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় সোমালিয়ার আল শাবাব, আফগানিস্তানের তালেবান ও ইসলামিক স্টেট, মালির দোজো মিলিশিয়া, কাশ্মীরের জইশ-ই-মুহম্মদ, পাকিস্তানের তাহরিক-ই-তালেবান, দল লস্কর-এ-জংভি, বেলুচ রিপাবলিকান আর্মি, নাইজেরিয়ার বোকো হারাম ও ইয়েমেনের আল-কায়েদার নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হামরায় দায় স্বীকার করেছে আইএস ও তালেবান।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক তারেক শামসুর রেহমানের মতে, সিরিয়াকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এতদিন ইউরোপের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে প্যারিস, লন্ডন ও ব্রাসেলসের মতো শহরে সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে আসছিল। এমনকি তারা আমেরিকাতেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পরিচালনা করেছে। সম্প্রতি তারা তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করছে এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও। মনে করা হচ্ছে মুসলমানরা যখানে সংখ্যালঘু সেখানেই তারা কর্মকাণ্ড বাড়াচ্ছে। নিউজিল্যাণ্ডের ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পর পর ওই গণহত্যার বদলা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল আইএস। শ্রীলঙ্কা সরকার রোববারের সন্ত্রাসী হামলায় ‘ন্যাশনাল তাওহিদ জামাত’ বা এনটিজে নামে যে উগ্র ইসলামিক সংগঠনের জড়িত থাকার খবর দিয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ আছে। এনটিজেকে বলা হয় আইএসের পূর্বসূরি। আগেও এদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের রেকর্ড আছে। গত বছর সেখানে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের সঙ্গে সংঘঠিত দাঙ্গার সময় বেশ কিছু ভাস্কর্য ভেঙে তারা আলোচনায় এসেছিল।

ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ শ্রীলঙ্কায় ২৬ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন তামিল টাইগাররা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ধর্মকে ব্যবহার করে কোনো সন্ত্রাসকাকাণ্ডে ঘটায়নি। এমনকি কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা পর্যটকের ওপর হামলার ঘটনাও নজিরবিহীন। বিচ্ছিন্নভাবে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটলেও তার ভয়াবহতা ছিল কম। গত বছর মার্চ মাসে দেশটিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে সেখানকার আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। দাঙ্গার পর থেকে সংখ্যালঘু মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। কিন্তু ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীর ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে সেখানকার মুসলমানদের সামাজিক অবস্থানকে আরও অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে।

বিবিসি সূত্রে জানা গেছে, সেখানকার মুসলিমদের অনেকেই তাদের ভাবমূর্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। রোববারের ঘটনার পর সে দেশের মসজিদগুলোতে পুলিশি পাহারা জোরদার করা হলেও মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা বলছেন, তারা যতটা না আতঙ্কগ্রস্ত তার চেয়ে বেশি লজ্জিত এবং দুঃখিত। তারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে তাদের সম্প্রদায়ের কেউ দেশের ভেতরে এ ধরনের হামলা করতে পারে। শ্রীলঙ্কার দুটি বড় ইসলামিক সংগঠন ‘দ্য মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কা’ ও ‘আয় সিলোন জমিয়াতুল উলেমা’ কলম্বোর সন্ত্রাসকাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে। সেই সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশেও ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।

এদিকে শ্রীলঙ্কায় সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে সন্ত্রাসী হামলার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তারপরও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে তারা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর বড় ধরনের হামলা করার শক্তি এখন নেই। এরপরও শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য দেশে হামলার ঘটনাসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তারা নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন।

গত রোববার সকালে কলম্বোর ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের তিনটি বড় গির্জা সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চ, সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ আর জিয়ন চার্চ এবং কলম্বোর পাঁচ তারকা হোটেল শাংরি লা, কিংসবুরি আর সিনামন গ্র্যান্ড একযোগে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়। মাত্র ২০ মিনিটে উপর্যুপরি এসব বিস্ফোরণে গতকাল পর্যন্ত প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে ৩২১ জনের। এদের মধ্যে ৩৫ জন বিদেশি নাগরিকও মৃত্যুবরণ করেছেন। নিহতদের মধ্যে শুধু খ্রিস্টান নয় রয়েছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধসহ আরও নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ।

 
Electronic Paper