নিরাপত্তা পরিকল্পনা ঢেলে সাজানোর দাবি
শঙ্কামুক্ত নয় বাংলাদেশ
কুন্তল দে
🕐 ১১:০০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৩, ২০১৯
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশও শঙ্কামুক্ত নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২০১৬ সালে গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার পর ধারাবাহিকভাবে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের ফলে উগ্রপন্থিদের হামলা চালানোর মতো শক্তি নেই। তবে শ্রীলঙ্কার হামলায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের ঝিমিয়ে পড়া উগ্রপন্থিরা নতুন করে অনুপ্রাণিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশে এ মুহূর্তে জঙ্গি হামলার ঝুঁকি দেখছেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এ বিষয়ে শঙ্কা নেই বলে আশ্বস্ত করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় গির্জা ও অভিজাত হোটেলে জঙ্গি হামলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থাপনায় নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স নাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম। শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলা যে বাংলাদেশের জন্যও বিপদের বিষয় হয়ে উঠতে পারে সেই শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলেও জানান।
নিউজিল্যান্ডের মসজিদে জঙ্গি হামলার ক্ষত শুকাতে না শুকাতে শ্রীলঙ্কায় যে সুপরিকল্পিত হামলা এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, উগ্রবাদীদের কবল থেকে কেউই এখন নিরাপদ নয়। সন্ত্রাসবাদ এখন শুধু আর আঞ্চলিক বিষয় নয়। কোথায়, কখন হামলা হবে তা বলা যায় না। তাই নিরাপত্তা নিয়ে আত্মতৃপ্তি বা শিথিলতার কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘শ্রীলঙ্কায় যে ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, বাংলাদেশও এ ধরনের হামলার ঝুঁকির মধ্যে আছে। সন্ত্রাসী হামলা তো আর বলে-কয়ে আসে না। তাৎক্ষণিক আক্রমণের একটা আশঙ্কা থেকেই যায়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ২০১৬ সালে যেমন হলি আর্টিজানে আক্রমণ হয়েছিল। সে সময় নিরাপত্তাবাহিনী সফলভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করেছে। তাৎক্ষণিক বড় হামলার শিকার হলে বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবিলা করবে তা শ্রীলঙ্কার কাছে শিক্ষণীয় আছে। বাংলাদেশ নিরাপদে আছে। এ দেশ থেকে এ ধরনের শক্তি অনেকটা দূর হয়ে গেছে এমন আত্মতুষ্টিতে যেন আমরা না ভুগী। চূড়ান্তভাবে এ ধরনের হুমকির মধ্যে বাংলাদেশ আছে। এজন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।’
শ্রীলঙ্কায় হামলার তিন দিন পর ওই হামলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস জড়িত বলে সংগঠনটির মুখপত্র হিসেবে পরিচিত আমাক নিউজ দাবি করেছে। তবে এ দাবির পেছনে কোনো প্রমাণ তারা হাজির করেনি। দেশটির কর্তৃপক্ষ মনে করছে, স্থানীয় কোনো উগ্রবাদী গোষ্ঠী পরিকল্পিত এ হামলা চালালেও এতে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র রয়েছে। শ্রীলঙ্কার মুসলিম অধ্যুষিত শহর কাট্টাকুডিতে ২০১৪ সালে গড়ে ওঠে ন্যাশনাল তাওহিদ জামাতকে দায়ী মনে করছে তারা। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তাওহিদ জামাতের সঙ্গে আইএসের যোগসূত্র রয়েছে।
বাংলাদেশেও গুলশানসহ বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনাতেও আইএস দায় স্বীকার করেছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বরাবরই এ সব হামলার সঙ্গে আইএসের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তাদের ভাষ্য স্থানীয় জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন এ সব হামলার পেছনে দায়ী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্বীকার না করলেও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা, এসব জঙ্গি হামলার পেছনে বৈশ্বিক যোগসূত্রের বিষয়টি বারবার করে উত্থাপন করেছেন। হোলি আর্টিজানে হামলার ধরনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার জঙ্গি হামলার অনেকটা সাদৃশ্য দেখছেন তারা।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করছেন এ ধরনের বিশ্লেষকদের শঙ্কা, সিরিয়ায় আইএসের পতনের পর এই উগ্র মতাদর্শিক জঙ্গিগোষ্ঠীটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগও রক্ষা করছে। আর নিজেদের হামলার টার্গেট হিসেবে এমন কোনো দেশকে বেছে নিচ্ছে যেখানে এ ধরনের হামলা হতে পারে তা কেউ ভাবতেই পারে না।
শ্রীলঙ্কার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কাউন্টার টেররিজমের প্রধান মনিরুল ইসলাম মনে করছেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিরা প্রতিবেশী দেশটির হামলা থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কেউ তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো সহিংস কর্মকাণ্ড যেন না ঘটাতে পারে, সেজন্য আমরা তৎপর রয়েছি। আমরা, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা সবাই সতর্ক রয়েছি।’
বাংলাদেশে জঙ্গিদের এখন বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই বলে দাবি করেন মনিরুল। আইএসে যাওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই মারা পড়েছেন কিংবা গ্রেফতার হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে কতিপয় লোক অধিকাংশ আইএসে গেছে ২০১৪ সালের শেষ দিকে। এদের পাসপোর্টের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং তারা ফিরতে হলে দূতাবাসে গিয়ে ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করতে হবে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যাচাই-বাছাই করেই ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করতে হবে। এরপরও কেউ বাংলাদেশে ফেরত আসতে চাইলে বিমানবন্দরেই ধরা পড়বেন।’
শ্রীলঙ্কার হামলা প্রসঙ্গে মনিরুল বলেন, শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল তাওহিদ জামায়াত হামলা চালালেও এর পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো সংগঠন যুক্ত। কারণ সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে একটা যোগাযোগ থাকে।
বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, বিশ্বে উগ্রবাদী বা জঙ্গি সংগঠনগুলো সব সময়ই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের মতের সঙ্গে মিল আছে এমন সংগঠনের সঙ্গে একটা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে জঙ্গিদের সাংগঠনিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়লেও তাতে স্বস্তিতে থাকা উচিত নয়। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদা আকতার এ বিষয়ে বলেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পুলিশ বা র্যাব অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আমরা যে পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত এমনটা নয়। আমরা এখনো জঙ্গিদের ধরার অনেক খবর পাই। এই খবরগুলো কিন্তু প্রমাণ করে, জঙ্গিদের অস্তিত্ব আছে। জঙ্গিরা দুর্বল হয়েছে, কিন্তু তাদের অস্তিত্ব টিকে আছে এটাও সত্য।’
শ্রীলঙ্কার জঙ্গি হামলার বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে রাখাইন থেকে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীরা এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে বলেও শঙ্কা তাদের।