আলোচিত তবুও প্রলম্বিত
ধর্ষণ ও হত্যা মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:২২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০১৯
গত চার বছরে বেশ কয়েকটি আলোচিত নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার ঘটনা ঘটেছে। একেকটি ঘটনার পর সারা দেশে আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দ্রুত তৎপরতা নেওয়া হলেও আলোচিত এসব অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত প্রলম্বিতই হচ্ছে। কোনো কোনো বিচার শুরু করাও যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আলোচিত এসব ঘটনার বিচার নিষ্পত্তি দ্রুত সময়ে হলে তা অপরাধীদের জন্য একটা বড় সতর্কবার্তা হতে পারত। বাস্তবে এর উল্টোটা ঘটায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে সংঘবদ্ধ অপরাধ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি আলোচিত ঘটনার প্রভাব একপর্যায়ে গিয়ে স্তিমিত হয়ে যায়। এরপর আবার নতুন আরেকটি ঘটনা এসে পড়ে। এ সুযোগে ওই ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া আর সামনের দিকে এগুতে চায় না। পুলিশ মামলা চার্জশিট দিতে বিলম্ব করে। চার্জশিট দিলেও বিচারিক আদালত ও উচ্চ আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একেকটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পতি হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। অনেক সময় ভুক্তভোগীর পরিবার বিচার পায় আবার অনেক সময় মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া এবং বিচারিক প্রক্রিয়া এত বিলম্বিত হয়, নিকট স্বজনরা মামলার বিচারের রায় আর দেখে যেতে পারেন না। সারা দেশে এরকম অসংখ্য ঘটনার মধ্যে কয়েকটি আলোচিত ঘটনা হচ্ছে- কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ড, রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী ছিলেন আফসানা ফেরদৌসী। এ দুটি ঘটনাই পুলিশ বলেছে, তাদের ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
এ ছাড়া সিলেটে সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী ছিলেন খাদিজা আক্তার নার্গিসের হত্যাচেষ্টা ঘটনাটিও ছিল বেশ আলোচিত। আর নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গত ৩১ ডিসেম্বর চার সন্তানের এক জননীকে গণধর্ষণ ঘটনাও গণমাধ্যমে বেশ সারা ফেলেছি। এ ছাড়া বগুড়ায় শ্রমিক লীগ নেতার দ্বারা মা মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনাটিও ছিল বেশ ন্যক্কারজনক।
সোহাগী জাহান তনু : সোহাগী জাহান তনু। একজন নাট্যকর্মী ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের অনার্সের ছাত্রী ছিলেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে টিউশনি করাতে গিয়ে আর বাসায় ফেরেনি তনু। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাতে তনুদের বাসার অদূরে সেনানিবাসের ভেতরের একটি জঙ্গলে তার মরদেহ পান স্বজনরা। পরে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন (কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যামামলা করেন। সারা দেশে ওইসময় তনু হত্যার বিষয়টি ছিল বেশ আলোচিত। তনু হত্যার পর তার সহপাঠীরা হত্যার বিচার চেয়ে আন্দোলন শুরু করেন। সে সময় সারা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষও তনু হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার দাবিতে আন্দোলন করেন। কিন্তু এখনো তনু হত্যা বিচার হয়নি। দোষীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
তনু হত্যার বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তৎকালীন কুমিল্লার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহ আবিদ হোসেন বলেছিলেন, তনু যে হত্যার শিকার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তাকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয়প্রধান ডা. কেপি সাহা আলোচিত ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, তনুর ময়নাতদন্তে ধর্ষণের কোনো আলামত নেই। পরে বিষয়টি সিআইডি তদন্ত করে। সিআইডির বিশেষ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ ওই সময় জানিয়েছিলেন, আমাদের ল্যাবে যে ডিএনএ টেস্ট করা হয়েছে, তাতে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। আলোচিত এ মামলাটির কবে বিচার হবে তা কেউ জানে না।
আফসানা ফেরদৌসী
রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী ছিলেন আফসানা ফেরদৌসী। তার গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের। তিনি ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট আফসানা হত্যার শিকার হন। আফসানা হত্যার লাশ পাওয়া যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। তার হত্যাকাণ্ডটিও ছিল সারা দেশে খুব আলোচিত। আফসানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তেজগাঁও সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান রবিনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। আফসানার ভাই ফজলে রাব্বি বাদী হয়ে কাফরুল থানায় মামলাটি করেন। এ হত্যাকাণ্ডটি ছিল বেশ আলোচিত। কিন্তু এ মামলার কবে বিচার শুরু হবে এবং কবে শেষ হবে কেউ জানে না। তখন পুলিশ জানিয়েছিল, মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
খাদিজা আক্তার নার্গিস হত্যাচেষ্টা
সিলেটে সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী ছিলেন খাদিজা আক্তার নার্গিস। তাকে ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা চালায় বদরুল আলম নামে এক যুবক। বদরুল সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছাত্রলীগ নেতাও ছিলেন। তিনি খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করত এবং বিয়ের প্রস্তাব দেয়। খাদিজা এতে সারা না দেওয়ায় তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চাপাতি দিয়ে কোপায়। চাপাতির কোপে খাদিজা গুরুতর জখম হওয়ার পর সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। খাদিজাকে কোপানোর ঘটনাটি গণাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। কিন্তু তার বিচার হতেও সময় লেগেছে এক বছরের মতো।
২০১৭ সালে ৮ মার্চ বিচারিক আদালত আসামি বদরুলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। আসামি বদরুলের আইনজীবী মো. সাজ্জাদুর রহমান চৌধুরী তখন বলেছিলেন, আমার মক্কেল ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আমরা রায়ের নকল তোলার পরপরই উচ্চ আদালতে আপিল করব। কিন্তু তারা আপিল করেনি। আপিল করলে মামলাটির চূড়ান্ত রায়ে হয়তো প্রলম্বিত হলেও হতে পারত।
সুবর্ণচরে গণধর্ষণ
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গত ২০১৮ সালে ৩১ ডিসেম্বর চার সন্তানের এক জননীকে গণধর্ষণ করেছে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা, কর্মী ও সমর্থক। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৩৫ বছরের ওই নারী অভিযোগ করেন, নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেওয়ায় তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। চর জুবিলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য রুহুল আমীনের নেতৃত্বে এই পাশবিক কাজ করা হয়েছে বলে জানান ওই নারী। তিনি বলেন, তারা আমাকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেছিল, কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে ধানের শীষে ভোট দিয়েছি।
এ কারণে ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর ১০ থেকে ১২ জন লোক হাতে লাঠিসোটা নিয়ে বেড়া কেটে তার বাড়িতে ঢুকে। তারপর তারা তার সিএনজিচালিত অটোরিকশার ড্রাইভার স্বামী ও চার সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর তারা আমাকে বাইরে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তিনি একথাও বলেন, এ বিষয়ে মুখ খুললে তার স্বামী ও সন্তানদের মেরে ফেলা হবে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছে ধর্ষণকারীরা। এ ঘটনার পর ওই নারীর স্বামী থানায় মামলা করে। মামলার পর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক (বহিষ্কৃত) রুহুল আমিনকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
এরপর হাইকোর্ট তাকে এক বছরের জামিনের আদেশ দিলেও পরে সে জামিন আদেশ প্রত্যাহার করে নেন। ৪ সন্তানের জননীকে ধর্ষণের ঘটনাটি ছিল বেশ আলোচিত। পুলিশ ১৬ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলেও এখনো মামলার বিচার শুরু হয়নি। মামলাটির কবে বিচার শুরু হবে এবং কবে তা চূড়ান্তভাবে শেষ হবে তা বলা কঠিন।
বগুড়ায় মা-মেয়ে ধর্ষণ
তুফান সরকার। বগুড়ার আলোচিত শ্রমিক লীগ নেতা। তার হতে মা ও তার কিশোরী কন্যা ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৭ সালে জুলাই মাসে এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু ওই ঘটনায় এখনো কোনো বিচার হয়নি তুফান সরকারের। মামলার কিছু আসামি এখনো পলাতক থাকায় মামলাটি চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।
বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের তৎকালীন আহ্বায়ক তুফান সরকার শহরের নামাজগড় এলাকার ভাড়া বাসা থেকে এসএসসি পাস এক কিশোরীকে ভালো কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তির প্রলোভন দিয়ে সহযোগীদের দিয়ে তুলে নিয়ে শহরের চক সূত্রাপুরের নিজ বাসায় ধর্ষণ করে। এ ঘটনার ১০ দিন পর ওই কিশোরী তার মাকে নিয়ে স্থানীয় সংরক্ষিত ২নং ওয়ার্ডের পৌর কাউন্সিলর মার্জিয়া হাসান রুমকির বাসায় গিয়ে বিচার চায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রুমকি ও তার ছোট বোন তুফানের স্ত্রী আশা মিলে মা ও মেয়েকে নির্যাতন করে দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দেয়।
এরপর স্থানীয় লোকজন দুজনকে অসুস্থ অবস্থায় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। এ ঘটনায় কিশোরীর মা বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় তুফান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি ছিল সারা দেশে বেশ আলোচিত। মা-মেয়েকে ধর্ষণকারী তুফানের কবে বিচার হবে তা বলা কঠিন।