ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গ্যাসের দাম বাড়লে লাভ হবে কার

রহমান মুফিজ
🕐 ১১:২৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৮, ২০১৯

গণশুনানিতে গ্রাহকদের পক্ষ থেকে দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় যুক্তি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরার পরও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। গত ১১ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘গ্যাসের দাম অবশ্যই বাড়বে। তবে তাতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে না। আর দাম বাড়ানোর কারণে ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়লে সরকার তা দেখবে।’ তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মূলত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারের অনড় অবস্থানই প্রকাশ পেয়েছে। এতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে গ্যাসের দাম বাড়লে আসলে লাভ কার?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবহন, বিদ্যুৎ, পণ্য উৎপাদনসহ সব খাতে ব্যয় বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে আবাসনের ভাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য। এমনিতেই বাড়িভাড়া, পরিবহনের দুষ্প্রাপ্যতা, যাতায়াতের ব্যয়বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতার কারণে প্রাত্যহিক প্রয়োজনকে কাটছাঁট করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, সেখানে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলবে বলে আশঙ্কা করছেন সাধারণ মানুষ।

গত ১১ থেকে ১৪ মার্চ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর রাজধানীর বিইআরসি কার্যালয়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরবরাহকারী কোম্পানি, ভোক্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজন উপস্থিত ছিলেন। ভোক্তা বা ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে নানা যুক্তি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি না করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু শুনানির এক মাস পূর্ণ না হতেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আভাস দেওয়াতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরতার আশঙ্কা জেঁকে বসেছে সবার মনে। যদিও ৯০ দিনের মধ্যে গণশুনানির সিদ্ধান্ত জানানোর বিধান রয়েছে, কিন্তু বিইআরসি এখনো সেই সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাসের দাম ঠিকই বাড়ছে-এমনই খবর জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।

বিইআরসির গণশুনানিতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা, তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স খোলা কাগজকে বলেন, ‘শুনানিতে আমরা প্রয়োজনীয় যুক্তি ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, কোনোভাবেই গ্যাসের দাম বাড়ানো উচিত নয়। সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন ভোক্তা ও অংশীজনের সবাই আমাদের যুক্তি মেনেও নিয়েছেন। কিন্তু সরকারের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, গণশুনানিতে আসা গ্রাহকমতকে উপেক্ষা করে তারা গ্যাসের দাম বাড়াবেই। বিইআরসি তো সরকারের কথার বাইরে যাবে না।

প্রিন্স বলেন, এলএনজি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই সরকার গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছে। লুটেরা, কমিশনভোগী ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য মরিয়া হয় উঠেছে সরকার। গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারার পেছনে আরও একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তা হলো-সরকার বিভিন্ন উন্নয়নের নামে যেসব লুটপাটের প্রকল্প হাতে নিচ্ছে তার অর্থ সংস্থান। অর্থাৎ জনগণের কাছ থেকে টাকা তুলে সেটা লুটপাটের প্রকল্পে ব্যয় করার অভিসন্ধি!

গত ১১ থেকে ১৪ মার্চের গণশুনানির প্রসঙ্গ তুলে প্রিন্স বলেন, শুনানি চলাকালে আদালত বলেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা ও তিতাসে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয় তার অর্ধেক কমালেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না। এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বন্ধের ব্যবস্থাগ্রহণের নির্দেশও দিয়েছেন আদালত। সেই সঙ্গে আদালত আরও একটি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন, তা হলো- গণশুনানি-পরবর্তী বিইআরসির সিদ্ধান্তে অধিকাংশের মতের প্রতিফল না ঘটলে আদালত নিজেই হস্তক্ষেপ করবেন। এর মধ্য দিয়ে বিইআরসিকে আদালত বোঝাতে চেয়েছেন, যুক্তির বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এরপরও যদি বিইআরসি গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় তখন ভোক্তা-গ্রাহকদের রাস্তায় নামা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। আমরা আন্দোলনেই আছি, প্রয়োজনে বৃহত্তর কর্মসূচি দিয়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঠেকাব।

বিইআরসির প্রস্তাব অনুযায়ী বাসাবাড়িতে একচুলা গ্যাসের দাম ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৫০টাকা এবং দুই চুলা গাসের দাম ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৪০ টাকা করার কথা বলেছে। এ ছাড়া যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজির দাম প্রতি ইউনিট ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ১০ টাকা এবং শিল্প-কারখানার বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট ৯ দশমিক ৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ০৪ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে থাকা সত্ত্বেও কেন গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি। কার স্বার্থে তারা গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব টেবিলে এনেছে? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বারবার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি দেশি বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রভাবে যেখানে শিল্প খাতে ব্যয় উত্তরোত্তর বাড়ছে সেখানে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্পের বিকাশ রুদ্ধ হবে। সেই সঙ্গে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোও মুখ থুবড়ে পড়বে।

ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দও মনে করেন, এ সময় গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। কারণ, গ্যাসের দাম বাড়লে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এর ফলে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ বিদেশি পণ্য কেনার দিকে ঝুঁকবে। বস্তুত গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সার্বিকভাবে দেশের শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শুধু শিল্প খাতে নয়, আবাসিক খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। এসব তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলেও জানান কেউ কেউ।

গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে পোশাক শিল্প ও বস্ত্র খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তাদের গলাটিপে মেরে ফেলা হচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীরা আর রক্ত দিতে রাজি নয়। গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে, পরিবহনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সব খাতে ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে সব ধরনের শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে বিইআরসির গণশুনানি চলাকালীন ভোক্তা সংগঠন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর পক্ষ থেকে হাইকোর্টে করা একটি রিট আবেদনের পর আদালত বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের যে মূল্য রয়েছে সেটা মেনেই দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানো বা কমানো উচিত। কারণ ভারত যেখানে ছয় ডলার দিয়ে গ্যাস কিনছে, সেখানে বাংলাদেশ কেন ১০ ডলার দিয়ে কিনবে? বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ মন্তব্য করেন, পেট্রোবাংলা ও তিতাসে দুর্নীতির ৫০ ভাগ কমালেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না বলে। মন্তব্য করেছেন উচ্চ আদালত।
পেট্রোবাংলা-তিতাসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের ভূমিকা নিয়েও উষ্মা প্রকাশ করেন বিচারক।

ক্যাবের ওই রিট আবেদনে বলা হয়, ‘২০১০ সালের আইনে গ্যাসের বিতরণ ও সঞ্চালন সংক্রান্ত প্রবিধানমালায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কতগুলো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণের কথা বলা আছে। কিন্তু এসব প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়াতে চাইছে পেট্রোবাংলা ও বিইআরসি। এখানে দাম বৃদ্ধির নামে যেটা হচ্ছে, সেটা হলো কোনো একটি বিশেষ মহলকে সুবিধা দেওয়া।’

রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়াকে আদালত সেদিন বলেছিলেন, গণশুনানির পর সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য বিইআরসি ৯০ দিন সময় পাবে। তারা আদেশ দিক, আমরা দেখব। আপনাকে নতুন মামলা করতে হবে না। যেহেতু উনারা গণশুনানি করছেন, তাই একটি সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ আছে। যদি তারা সিদ্ধান্ত দেয় এবং আপনারা সংক্ষুব্ধ হন, তাহলে আদালতে আসার সুযোগ আছে। তখন আপনারা আসবেন, তখন আমরা এটা স্থগিত করব। উনাদের (বিইআরসি) কাজ করতে দিতে চাই।

ক্যাবের উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘গ্যাসের দাম বাড়লে পরিবহন, বিদ্যুৎ, পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সব খাতে ব্যয় বাড়বে। বাড়তি ব্যয়ের প্রতিটি অর্থ ব্যবসায়ীরা জনগণের কাছ থেকেই পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে আদায় করা হবে। এর অর্থ গ্যাসের বাড়তি মূল্য সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে। ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আর লাভবান হবেন মাত্র ৫ থেকে ১০ ভাগ মানুষ। গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন লাভে আছে। তাদের আরও লাভ দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে সরকার। অথচ সরকারের উচিত জনগণের পক্ষে দাঁড়ানো সেখানে হচ্ছে তার উল্টোটা।

 
Electronic Paper