ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিচ্ছে রোহিঙ্গারা

ওয়াহিদ রুবেল
🕐 ১১:১৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৮, ২০১৯

বাংলাদেশি পাসপোর্ট না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গোপনে ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজার শহরের একটি হোটেল থেকে সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারাই এ তথ্য জানিয়েছেন। তাদের দাবি রোহিঙ্গা ক্যাম্প এখন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। তাই স্বাভাবিক ও নিশ্চিত জীবন যাপন করতে তারা ক্যাম্প ছাড়ছে। এ পর্যন্ত অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে। আর ক্যাম্প ছেড়ে স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে গেছে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। বিদেশে থাকা আত্মীয়দের প্ররোচনায় রোহিঙ্গাদের এ অংশটি ক্যাম্প ছাড়ছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিদিনই শত শত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছেন। এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে কিছু রোহিঙ্গা আটক হলেও বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুযোগ বুঝে তারা নাগরিকত্ব নেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টাও চালাচ্ছে। যদিও কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আবু নাঈম মাসুম খোলা কাগজকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা এখন আর আগের মতো বাংলাদেশি পাসপোর্ট জোগাড় করতে পারছে না। পাসপোর্টের আবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খ তদারকি না করে কোনো পাসপোর্টই দেওয়া হচ্ছে না। আগে স্থানীয় কিছু জনপ্রনিধি টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন, চেয়ারম্যান সনদ প্রদান করত। ফলে সহজে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়ে যেত। এখন সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। পাসপোর্ট করতে এসে অনেক রোহিঙ্গা ও স্থানীয় দালাল গ্রেপ্তার হয়েছে। এ পর্যন্ত কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসে ১০ মামলায় ১২ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। সন্দেহজনক আবেদন জব্দ করা হয়েছে ৩০১টি।

এদিকে পাসপোর্ট না পেয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে গিয়ে গত এক মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হতে আটক হয়েছে শতাধিক রোহিঙ্গা। পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে ৯ দালালকে। সর্বশেষ ১৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের একটি হোটেল থেকে ২২ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় আটক করা হয় দুই দালাল চক্রের সদস্যকে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দাবি, স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষা ও চরিত্রগত মিল থাকায় অনেক সময় তাদের আটকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এ সুযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর অবস্থানের কারণে অত্যন্ত সুকৌশলে ক্যাম্প ছাড়ছে তারা।

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুজ্জামান চৌধুরী খোলা কাগজকে বলেন, সীমান্তে যে কোনো ধরনের অপরাধ দমনে কঠোর অবস্থানে রয়েছি। তারপও তারা অত্যন্ত সুকৌশলে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। গত এক মাসে মালয়েশিয়াগামী বহু রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে দালালদেরও। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।

জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় পালিয়ে থাকা ৩ হাজার ৭৭০ জন রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফেরত আনা হয়েছে। ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তল্লাশিতে ধরা পড়ার পর ক্যাম্পে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৫৪ হাজার ৮০১ জন রোহিঙ্গাকে। এসব রোহিঙ্গাকে ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে সহযোগিতার করার অপরাধে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাসহ ৫৬৬ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৫৬১ জনের নামে ২৮৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ হাবিব ছড়া এলাকায় পাচারের জন্য জমায়েত করে রাখা ৩ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উদ্ধার করে বিজিবির সদস্যরা। এর আগের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের হোটেল রাজমনি থেকে ২ দালালসহ ১৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে র‌্যাবের একটি দল। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মহেশখালী সোনাদিয়া মকচুরের মাজার নামক স্থানের প্যারাবন থেকে ৩১ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬ রোহিঙ্গা, ১০ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে শাহপরীর দ্বীপ খুরেরমুখ এলাকা থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে শিশুসহ ২২ রোহিঙ্গা, ৮ ফেব্রুয়ারি পৃথক অভিযানে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ঘোলাচর এবং নোয়াখালী এলাকার সৈকতপাড়া থেকে ২৮ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে বিজিবি ও পুলিশ।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একে এম ইকবাল হোসেন জানান, মাত্র ৬ হাজার একর জমিতে সাড়ে এগারো লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আবদ্ধ রাখা ছোটখাটো বিষয় নয়। তারপরও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। সাদা পোশাকে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজন।
তিনি বলেন, এক সময় স্থানীয় কিছু লোভী ও স্বার্থান্বেষী জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে সহজে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাতো রোহিঙ্গারা। এখন প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে পাসপোর্ট পাওয়া বন্ধ হয়েছে। ফলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাচ্ছে। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেন রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য জেলা পুলিশ সর্বদা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

অপরদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে থাকা খাওয়ার সমস্যা না থাকলেও ছোট কুঁড়েঘরে দীর্ঘদিন বসবাস করতে করতে তারা হাঁপিয়ে উঠেছেন। একঘেঁয়ে জীবন পার করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে তাই চাকরির প্রত্যাশায় সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন দলে দলে। সেখানেই জীবনের বাকি সময় কাটিয়ে দিতে চাইছেন তারা।

এদের মধ্যে রোহিঙ্গা নারীরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মেয়েদের জীবনের কোনো মূল্য নেই। প্রতিরাতেই রোহিঙ্গা পুরুষদের হাতে ধর্ষিত হচ্ছে তরুণীরা। অনেকটা অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাদের। বিয়ের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় কোনো রীতিনীতি মানা হচ্ছে না। মৌখিকভাবে বিয়ে হলেও কয়েকদিন পর তালাক দেওয়া হয় তাদের। রোহিঙ্গাদের কাছে অনেকটা দাসির মতো জীবন যাপন করতে হয় নারীদের। তাই পরিবারের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ক্যাম্প ছাড়ছেন তারাও।

তাদের দেওয়া তথ্যমতে, স্থানীয় কিছু যুবকের মাধ্যমে নৌকা সংগ্রহ করা হয়। আর ওইসব নৌকায় চড়ে গভীর সাগরে থাকা জাহাজে তুলে দেওয়া হয় তাদের। জাহাজগুলো তাদের মালয়েশিয়া সীমান্তে পৌঁছে দেয়। মাঝে মধ্যে কিছু লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হলেও বেশিরভাগই মালয়েশিয়া পৌঁছতে পারছে। উখিয়ার বালুখালী, থাইংখালী, কুতুপালং এবং টেকনাফ মুছনি ক্যাম্প থেকে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধলক্ষ রোহিঙ্গা মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে। মালয়েশিয়া গিয়েই মোবাইল ফোনে তারা অন্যদেরও যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করে।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, হঠাৎ করে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উচ্চাভিলাষী জীবনের স্বপ্ন নিয়ে তারা মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে।

উখিয়া উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক কমরুদ্দিন মকুল বলেন, রোহিঙ্গাদের অনেক আত্মীয় মালয়েশিয়া রয়েছে। সেখান থেকে তারা আত্মীয়দের মালয়েশিয়া নিতে চেষ্টা করছে। এখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট না পেয়ে তারা সাগরপথকে বেছে নিয়েছে। মূলত ভাগ্য পরিবর্তন করতে তারা ক্যাম্প ছেড়ে যাচ্ছে। আর তাদের কারণে বিপদে পড়ছে আমাদের দেশীয় লোকজন।

ক্যাম্পে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, দেশে রোহিঙ্গা ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে বিকাল ৫টার পর ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার লোকজন ক্যাম্প ত্যাগ করেন। এছাড়া ক্যাম্পে এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বারোটি ভ্রাম্যমাণ দল কাজ করছে। যেসব দলের প্রধান হিসেবে রয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। নতুন করে আরো পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ দলের অনুমোদন চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে ক্যাম্পে দ্রুত সময়ের মধ্যে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নও কার্যক্রম শুরু করার কথা রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে এগারো লাখ রোহিঙ্গা। বাস্তুচ্যুত এসব রোহিঙ্গা উখিয়ার এবং টেকনাফের ৬ হাজার একর বনভূমিতে আশ্রয় দেয় সরকার।

 
Electronic Paper