ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নতুন হোক পুরান ঢাকা

সমন্বিত উদ্যোগ চান নগরবিদরা

রহমান মুফিজ
🕐 ১১:১৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯

রাজধানীর চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানির পর পুরান ঢাকাকে নতুন করে সাজানোর দাবি উঠছে। এ এলাকার দীর্ঘদিনের পুরনো ঘিঞ্জি ও ঝুঁকিপূর্ণ বসতবাড়ি, সংকীর্ণ চলাচলের রাস্তা, অপরিকল্পিত বিদ্যুতায়ন, গ্যাস সংযোগ সংস্কারের পাশাপাশি আশপাশে পানির উৎস সৃষ্টি এবং খোলামেলা জায়গা তৈরির কথা বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। এ ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা অক্ষত রেখে সংস্কার ও সুরক্ষার বিষয়ে জোর দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন সবাই। সংশ্লিষ্ট সবাই একবাক্যে বলছেন, পুরান ঢাকা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ বটে কিন্তু সেখানকার রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা বা গুদাম কখনই ঐতিহ্যের অংশ হতে পারে না। এগুলো একেবারেই অবৈধ। ফলে এগুলো আগে সরাতে হবে।

তা নাহলে যত পরিকল্পনাই হোক ঝুঁকি রয়েই যাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে এ এলাকাকে মুনাফার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালীরা। এভাবে দিনের পর দিন পুরান ঢাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে। এখন সময় এসেছে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে পুরান ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকাকে ঢেলে সাজানোর। ২০১০ সালের নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছিলেন ১২৪ জন। সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরও এলাকার বাসিন্দাদের অসচেতনতা ও কর্তৃপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর গাফিলতির কারণে চকবাজারের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে; যেখানে এ পর্যন্ত ৬৭ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। গত বুধবার রাতের এ দুর্ঘটনাকে অনেকে মানবসৃষ্ট বলেও মন্তব্য করছেন। কিন্তু এর দায় নিচ্ছেন না কেউ। এমনকি সমস্যার গোড়ায় না গিয়ে আগুনের সূত্রপাত গ্যাস সিলিন্ডার থেকে হয়েছে নাকি অন্য কিছু থেকে হয়েছে তা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় তর্কে মেতে উঠছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু গোটা পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর অপরিকল্পিত বিস্তৃতি, সর্বত্র ইমারত নির্মাণ আইনের লঙ্ঘন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগে ত্রুটি, অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কারখানার অনুমোদন ও রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ গড়ে ওঠার বিষয়গুলোকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন মন্ত্রী-মেয়র ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তারা। আগুনের সূত্রপাত যেখান থেকেই হোক তার ভয়াবহতা যে রাসায়নিক দ্রব্যের কারণে এবং অপরিকল্পিত আবাসনের কারণে উদ্ধার কাজে চরম বিঘ্ন ঘটেছে তা অবশ্য বলেছেন অনেকেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে গতকাল শনিবার থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকনও ওই এলাকার রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ সরানোর কাজ শুরু করেছেন।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বাসিন্দাদের নিরাপত্তার কথা প্রথম বিবেচনায় রেখে পুরান ঢাকাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে সরকারকে। কোনো দুর্ঘটনায় একজন মানুষেরও যেন প্রাণহানি না ঘটে সে ব্যবস্থা করতে হবে। রাসায়নিক পণ্যের মজুদসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা স্থানান্তরে পাশাপাশি গোটা অঞ্চল সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ডিএসসিসি, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসহ অন্য সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত পরিকল্পনায় সে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) আওতায় সম্প্রতি রাজউকের নেওয়া ল্যান্ড রি-ডেভেলপমেন্ট বা ভূমির পুনঃউন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছর রাজউক পুরান ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে এ ফর্মুলায় একটি বিস্তৃত পরিকল্পনার কথা বলেছিল। রাজধানীর পুরান ঢাকাসহ অন্যান্য ঘিঞ্জি এলাকাগুলোকে আরও প্রশস্তকরণ ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত স্থাপনা বা বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এ ফর্মুলায়। এ সংক্রান্ত বিধিমালাও প্রস্তুত করে রেখেছে রাজউক। বিশেষ করে জমির মালিকদের মালিকানা অক্ষুণ্ন রেখে সরু গলি, অপরিকল্পিত ও জরাজীর্ণ অবকাঠামো ভেঙে চলাচলের পথ প্রশস্তকরণ, উন্মুক্ত স্থানযুক্ত বাসস্থান তৈরি, প্রয়োজনীয় জলাধার তৈরি ও হারিয়ে যাওয়া জলাধার উদ্ধার করে আকর্ষণীয় নগরীতে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে ওই বিধিমালায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ল্যান্ড রি-ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার অনেক ঘিঞ্জি এলাকাকেই উন্নত শহরে পরিণত করা হয়েছে। এমনকি ভূমির পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে সেসব দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যও করা হয়েছে আকর্ষণীয়। সেসব এলাকা এখন পর্যটনের জন্যও বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা অক্ষত রেখে বা সংস্কার করে পুরান ঢাকাকেও বাসযোগ্য ও নিরাপদ শহরে পরিণত করা যাবে, যদি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়। নগরবিদরা বলছেন, এ ফর্মুলার সবচেয়ে বড় সুবিধা-জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হয় না। পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে ভূমির মালিক ও স্থানীয় ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তবে ভূমির পুনঃউন্নয়নের ধারণা বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। তাই এ ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আস্থা ও আগ্রহ তৈরির জন্য প্রথমে এক বা একাধিক ছোট পাইলট প্রকল্প নেওয়ার প্রতি জোর দিচ্ছেন তারা। রাজউক সূত্র জানিয়েছে, দু’এক বছরে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার মতবিনিময়ও করা হয়েছে। বাসিন্দাদের পরামর্শেই পরীক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপেও ভূমি পুনঃউন্নয়ন সংক্রান্ত নির্দেশনা রাখা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বড় এলাকা নিয়ে এ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করলে নাগরিক সুবিধা বেশি পাওয়া যাবে। তবে সর্বনিম্ন এক একর জায়গার ওপরও এ ফর্মুলা বাস্তবায়ন সম্ভব।

পুরান ঢাকার আমূল সংস্কার বা পুনঃউন্নয়নের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সময়, মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, অনেক আগেই পুরান ঢাকাকে নিয়ে ভাবা উচিত ছিল সংশ্লিষ্টদের। নিমতলী ও চকবাজারের দুর্ঘটনা আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পুরান ঢাকার সংস্কার মানেই রাসায়নিক গুদামে স্থানান্তর নয়। মনে রাখতে হবে কোনো আবাসিক এলাকাতেই এমন কারখানা থাকা নিরাপদ নয়। এখানে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ থাকাটা অবৈধ এবং অন্যায়। এত বড় দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে নিশ্চয় আমরা সেটা বুঝতে পারছি।

পুরান ঢাকাকে নতুন করে সাজানোর ব্যাপারে ইশরাত ইসলাম বলেন, পুরান ঢাকা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। বিশেষ করে সেখানকার অনেক স্থাপনার প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। লাখো মানুষ সেখানে বসবাস করছেন। সেখানে ল্যান্ড রি-অ্যাড্রেসমেন্ট বা রি-ডেভেলপমেন্ট করতে হলে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষতির মুখে না ফেলেই করতে হবে। সারা দুনিয়াতেই বিভিন্ন পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ নগরের পুনঃউন্নয়ন করা হয়। এতে দেশ এবং ওই নগরের বাসিন্দা সবাই উপকৃত হন। পুরান ঢাকার ক্ষেত্রেও এর বাসিন্দাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের বিষয়টি ভাবতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি বাসিন্দা বা ভূমি মালিকদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। রি-ডেভেলপমেন্টের প্রক্রিয়া ঘোষণা দিয়েই বাস্তবায়ন করা যাবে না।
সংশ্লিষ্ট বাসিন্দাদের এ জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে। দ্রুততার সঙ্গেও এটা করা সম্ভব নয়। রাজউক শোকেস প্রজেক্ট বা পাইলট প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে দেখাতে পারলে এতে সবার আগ্রহ ও আস্থা বাড়বে।

নগরবিদ ও সেভ পুরান ঢাকার আহ্বায়ক তাইমুর ইসলামের মতে, পুরান ঢাকার উন্নয়ন, বিকাশ, ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের ক্ষেত্রে এর ঐতিহাসিক গুরুত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সংরক্ষণ ও সংস্কারে যত্নশীল হতে হবে। সেসব স্থাপনা, বসতবাড়ি বা এলাকা সংরক্ষণের নামে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে যেন কোনো অবস্থাতেই ওইসব এলাকার ঐতিহাসিক আবহ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা উচিত। তিনি মনে করেন, নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সুপরিচিত একটি পদ্ধতি রয়েছে যাকে বলা হয়ে থাকে, ট্রান্সফার অব ডেভেলপমেন্ট রাইট (টিডিআর) অথবা হস্তান্তরযোগ্য উন্নয়ন অধিকার। এ পদ্ধতিতে মুম্বাই, চেন্নাই, হায়দরাবাদসহ অনেক ঘিঞ্জি শহরকে সংস্কার করে সফলতা পেয়েছে ভারত। এতে ঐতিহ্য এবং ভূমি বা স্থাপনা মলিকদের অধিকার পুরোমাত্রায় সংরক্ষিত হয়েছে। টিডিআরের মূল বিষয়টিই হলো, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মালিকের মালিকানা অক্ষুণ্ন রেখে জমিতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ উন্নয়ন করা। এটি তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রয় করে মালিক যেমন লাভবান হতে পারেন তেমনি তেমনি এই হস্তান্তরযোগ্য উন্নয়ন অধিকার কিনে কোনো ডেভেলপার অন্য কোনো স্থানে তার নির্মিতব্য ভবনে বাড়তি ফ্লোর এরিয়া বানানোর সুযোগ নিয়ে লাভবান হতে পারেন।

 
Electronic Paper