সিলিন্ডারই দায়ী!
কেমিক্যাল ব্যবসা আড়ালের চেষ্টা
সুলতান মাহমুদ
🕐 ১০:৫৭ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পেছনে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের ভূমিকা আড়াল করার জন্য সবাই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণকে দুষছেন। আগুন লাগার পর ব্যবসায়ীদের তেমন কাউকে ঘটনাস্থলে পাওয়া না গেলেও এখন তারা পুরো ঘটনাস্থলজুড়ে। বিশেষ করে ওয়াহেদ মেনশনের আন্ডার গ্রাউন্ডে কেমিক্যালের গোডাউনের সন্ধান পাওয়ার পর ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি বেশি লক্ষ্য করা যায়। ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, গাড়ির সিলিন্ডারের কারণেই এই অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। তারা কেমিক্যালের কথা একবারও বলছেন না।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ওই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য না থাকলে আগুনের তীব্রতা এত বাড়ত না এবং এত মানুষ হতাহতের ঘটনাও ঘটতো না। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা ব্যবসায়ীদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। আর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কেমিক্যালের বিষয়টি আড়াল করার জন্য বারবার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কথা সামনে নিয়ে আনছেন।
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন গত বৃহস্পতিবার চকবাজারের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ থেকেই চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে পাশের ভবনে কেমিক্যাল না থাকলে শুধু সড়কে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে এরকম তীব্র আগুন ছড়ানো সম্ভব কি না সে সম্পর্কে কিছু বলেননি শিল্পমন্ত্রী। স্থানীয়দের দাবি আগুন যেভাবেই লাগুক ভবনে বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ না থাকলে আগুনের তীব্রতা এত ব্যাপক হওয়া সম্ভব ছিল না।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সবাই সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কথা বলছেন কিন্তু কেউ কেমিক্যালের কথা বলছেন না। কারণ কেমিক্যালের পেছনে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। তাই ব্যবসায়ীদের খুশি রাখার জন্য তাদের বিপক্ষে কেউ কথা বলছেন না। কেমিক্যালকে আড়াল করতে সবাই গ্যাস সিলিন্ডারের কথা বলছেন। কেননা গ্যাস সিলিন্ডারের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা নেই।
গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ফের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা গেছে গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এ ছাড়া পুলিশের মাধ্যমেও জানতে পেরেছি গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন লেগেছে।
সাইফুল ইসলাম নামে স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী (নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দেন) দাবি করেন, আগুন লাগার পেছনে মূল কারণ গ্যাস সিলিন্ডার। আগুনের সঙ্গে কেমিক্যালের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা সেদিকে নজর দিক।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলেছেন, আগুনের সূত্রপাত যাই হোক আগুনকে তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী করেছে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় থাকা বিপুল পরিমাণ বডি স্প্রে ও দাহ্য পদার্থ। ফায়ার সার্ভিসের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত স্থানীয় অনেক বাড়ির মালিক ও বাসিন্দারা। তবে ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে এবং ভয়ে তারা মুখ খুলতে পারছেন না বলেও জানান।
ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনটির মালিক দুই ভাই সোহেল ও হাসান। তারা এখানে সপরিবারে বসবাস করতেন। হাসান ঘটনার আগের দিন সপরিবারে ঢাকার বাইরে যান। সোহেল ঘটনার সময় বাসায় থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে পরিবার নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলেও ওই প্রত্যক্ষদর্শী জানান। ভবনটির দ্বিতীয় তলায় থাকা বডি স্প্রের গোডাউনটি ভবন মালিকদের নিজেদেরই।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, এই এলাকার অনেক বাড়িওয়ালাই কেমিক্যাল দিয়ে জিনিস বানান। তাদের কোনো ফ্যাক্টরি নাই। যে যার বাসায় বানায়। বাসাই ফ্যাক্টরি, বাসাই গোডাউন। যে সব বাড়ির মালিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন, বাড়তি ভাড়া ও মুনাফার আশায় তারাও আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিচ্ছেন। আশপাশের ভবনগুলোয়ও এরকম আরও অনেক গুদাম আছে, প্রশাসন একটু নজরদারি করলেই এগুলো খুঁজে বের করতে পারে।
অগ্নিকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তু হওয়া ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচ তলায় প্লাস্টিকের দোকানটি ছিল হাজী আব্দুল কাদেরের। পাঁচ বছর ধরে এখানে মুক্তা প্ল্যাস্টিক নামে একটি দোকানের মাধ্যমে তিনি ব্যবসা করে আসছিলেন। দীর্ঘদিন এখানে ব্যবসা করার পরে তিনি জানেন না ভবনটিতে কয়টি ফ্ল্যাট ছিল, কতজন বসবাস করত কিংবা ভবনের পার্কিংয়ের জায়গায় ভয়ঙ্কর কেমিক্যালের গুদাম রয়েছে।
স্থানীয়দের ধারণা, আব্দুল কাদেরের মতো অনেকেই জেনেশুনে মূল ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। কারণ প্লাস্টিক তৈরির গুটিদানা, বডি স্প্রে, বৈদ্যুতিক লাইট, প্লাস্টিকের খেলনাসহ নানা জিনিস তৈরি হয় এই এলাকাজুড়ে। উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে।