ইঁদুর বিড়াল খেলা আর কত
নিমতলী থেকে চকবাজার ট্র্যাজেডি
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:১০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯
চকবাজার ট্র্যাজেডির দায় অস্বীকার ও দোষ চাপানোর পুরনো ইঁদুর-বিড়াল খেলা শুরু হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরা একেকজন একেক কথা বলছেন। দায় এড়ানো বা দোষারোপের দৃষ্টান্তও দেখা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, পুলিশ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানই নিজেদের গাফিলতির কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত টাস্কফোর্সের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন কেন হয়নি তারও সদুত্তর মিলছে না কারও কাছে।
চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই শিল্প মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছে বুধবার রাতে পুরান ঢাকার চকবাজার চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড কেমিক্যালের কারণে নয়, গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে ঘটেছে। তারা দাবি করেছে চকবাজারে কোনো রাসায়নিক কারখানা বা দাহ্য পদার্থ ছিল না। অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি বলছে কেমিক্যালের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
এ তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান বলেন, ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের পদার্থ ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এ ছাড়া পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হতো এখানে। সেই বোতলগুলো বোমের মতো কাজ করেছে। এই কথাকে সমর্থন করে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এত মানুষ নিহত ও ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। ঘটনাস্থলে বেশ কিছু কেমিক্যালের দোকান রয়েছে। যে ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত সেই ওয়াহিদ ম্যানশনের নিচে ছিল কয়েকটি প্লাস্টিকের দোকান। ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষ তিনি গতকাল বলেন, তিনটি কারণে আগুন লাগতে পারে। কারণগুলো হচ্ছে-ট্রান্সফরমার, গ্যাস সিলিন্ডার অথবা কেমিক্যাল বিস্ফোরণ।
গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে চকবাজারের চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ সংলগ্ন আসগর লেন, নবকুমার দত্ত রোড ও হায়দার বক্সলেন-এর মিলনস্থলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ৬৭ জন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও অনেকে। এ ঘটনায় পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস, ডিএসসিসি, ডিপিডিসি (ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) ও বিস্ফোরক পরিদপ্তর। এর মধ্যে ৪৮ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাদের দেওয়া প্রতিবেদন অন্য তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান ও বিশ্লেষকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন খোদ শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনের বক্তব্যে।
তিনি গত বৃহস্পতিবার চুড়িহাট্টা পরিদর্শন শেষে বলেছেন, পুরান ঢাকার চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাসায়নিক গুদামের কোনো সম্পর্ক নেই। ওই ভবনে কোনো রাসায়নিক গুদামও নেই। এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।
তিনি বলেন, সেখানে পারফিউম ও কসমেটিকসের গোডাউন ছিল। এসবের সঙ্গে কেমিক্যালের কোনো সম্পর্ক নেই। শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও মন্ত্রীর কথারই প্রতিধ্বনি হয়েছে। অথচ ডিএসসিসির তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ও ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান বলছেন, অবশ্যই কেমিক্যাল ছিল। যা যা ছিল, সেগুলো এক ধরনের কেমিক্যাল। কেমিক্যালের জন্যই আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে বেশি।
কেউ কেউ বলছেন, দায় এড়াতেই মন্ত্রীর বক্তব্যে এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে চুড়িহাট্টা এলাকায় রাসায়নিক পদার্থের গোডাউন থাকার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। এ বক্তব্যের পেছনে মানবসৃষ্ট এমন দুর্যোগের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রক্ষার অভিসন্ধিও দেখছেন অনেকে।
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা স্মরণ করে অনেকেই বলছেন, রাসায়নিক দ্রব্যের অপরিকল্পিত গুদাম ও প্লাস্টিক কারখানার কারণেই সেদিন ৬০ পরিবারের ১২৪ জন মানুষ পুড়ে মারা গিয়েছিল। ওইসব কারখানার ক্ষেত্রে যথাযথ অনুমোদন, পরিবেশ আইন, এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনসহ সংশ্লিষ্ট কোনো আইনেরই প্রয়োগ হয়নি। বেশির ভাগই ছিল অবৈধ। এসব কারখানার ব্যবস্থাপনা, অনুমোদন এবং মনিটরিংয়ে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কথাও উঠে আসে তদন্তে। ঘটনার পর গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটি ৩৮টি সুপারিশ দিয়েছিল। যেখানে রাজধানীর আবাসিক এলাকা থেকে অনুমোদিত রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে ফেলার কথা বলা হয়। এ ব্যাপারে সরকার আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা রাসায়নিক দ্রব্যের বৈধ-অবৈধ গুদাম সরাতে উদ্যোগও নিয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ মাঝপথে কোনো এক অদৃশ্য কারণে থেমে যায়। টাস্কফোর্সের কোনো সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি নিমতলীর ঘটনার নয় বছর পরও পুরান ঢাকার রাসায়নিক কারখানাগুলো পরিচালনায় কোনো নীতিমালাও তৈরি হয়নি। ফলশ্রুতিতে নিমতলীর আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার আগেই চকবাজারে বুধবারের ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চকবাজারের এ অগ্নিকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এবং ক্ষমতাশালী সিন্ডিকেট ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও দায়ী করেছেন অনেকে। এমনকি স্থানীয় বাসিন্দাদের অসচেতনতার কথাও উঠে আসছে অনেকের কথায়। বলছেন, সরকার, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এমনকি স্থানীয় মানুষ-কেউই এমন পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারে না। এখানকার অধিকাংশ বাড়ি গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। সাধারণত পরিবার নিয়ে কেউ বাড়ি ভাড়া নিতে চায় না। এই সুযোগে রাসায়নিক পণ্যের ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে গোডাউন ভাড়া নেন। একই বিল্ডিংয়ে রাসায়নিকের গোডাউন প্লাস্টিকের কারখানা ও আবাসিক বাসিন্দাদের অবস্থান হওয়া সব সময় ঝুঁকির মুখে থাকতে হয় সবাইকে। একটা সিগারেটের আগুনেই যে কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে এখানে। অথচ সরকার বা প্রশাসন এখানে কোনো ধরনের আইনই প্রয়োগ করে না।
পরিবেশ সংগঠকরা বলছেন, পুরান ঢাকায় যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের কয়েক হাজার গুদাম, কারখানা বা দোকান রয়েছে যার বেশির ভাগের অনুমোদন নেই। এসব ব্যবসায়ী এবং তাদের সহায়তাকারী স্থানীয় লোকজনের বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে। ফলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ নিয়ে কথা বলেন না। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানকার বাড়ির মালিক, রাসায়নিক ব্যবসায়ী ও স্থানীয় প্রতিনিধি মিলে একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিভাবেও শক্তিশালী। ফলে সরকার কোনো উদ্যোগ নিলে সেটা বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ বা পরিবেশ অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশনেরও রয়েছে গাফিলতি।
নিমতলীর ঘটনার পর তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া অবৈধ রাসায়নিক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান এবং কারখানা স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন। চকবাজারের ঘটনার পর যখন নিমতলী ঘটনা-পরবর্তী সরকারের উদ্যোগ ও ব্যর্থতা নিয়ে কথা উঠেছে তখন তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, পুরান ঢাকার রাসায়নিক পণ্যের ব্যবসায়ীরা নীতিগতভাবে ঠিক করেছিলেন, তারা চলে যাবেন। আমরা কেরানীগঞ্জে সে রকম জায়গাও ঠিক করেছিলাম। এর আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো করতে গিয়ে আমার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর যারা কর্মকর্তা ছিলেন, তারা আর তা ফলোআপ করেননি। ফলে কারখানা আর সরানো হয়নি। চকবাজারের ঘটনার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন মন্ত্রী ও ডিএসসিসির মেয়র প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দ্রুত রাসায়নিক ব্যবসা কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলোর অনিয়ম ও গাফিলতির কারণে এত মানুষের জীবনহানির বিচার কে বা কারা করবে সে কথা রয়ে যাচ্ছে উহ্য।
এদিকে পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে সরকারি সংস্থার কোনো অবহেলা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। ঘটনার উৎস ও কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের টিম।
শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তিনি জানান, ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কমিটি কাজ করবে। কারও গাফিলতি আছে কিনা তাও খুঁজে বের করা হবে। নিমতলী ট্র্যাজেডির তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি, চকবাজারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে জানান এ প্রতিবেদন অবশ্যই আলোর মুখ দেখবে।