ঘরহীন বাবলু সর্দার এখন সফল চাষি
তানিয়া আক্তার
🕐 ১০:৪০ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯
ঘরহীন এক শিশুর খাওয়া-পরা জুটত পরের বাড়ি কাজ করে। হাড়ভাঙা খাটুনির মাঝেও স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়াত তাকে। সেই শিশুটিই তার লালিত স্বপ্নের সফল রূপান্তর ঘটিয়েছেন যৌবনে। সেই স্বাপ্নিক মানুষটি বাবলু সর্দার। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভূমিহীন চাষি থেকে হয়ে উঠেছেন সফল উদ্ভাবক। ঢেঁড়শ গাছ থেকে বিকল্প আঁশ, আতা ও নিমপাতা থেকে কীটনাশক, কলাগাছ থেকে সার, বেগুন গাছে টমেটো ফলিয়ে তিনি এখন স্বাবলম্বী তো বটেই অনেক চাষির আদর্শও। বাবলুর বিচিত্র উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে হতবাক গ্রামবাসী তার নামটাই পাল্টে দিয়েছেন! বাবলু সর্দার থেকে তিনি এখন বাবলু কোম্পানি। জাতীয় পর্যায়েও মিলেছে স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি।
বাবলু কোম্পানির জন্ম কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান মালিথাপাড়া গ্রামে। বাবা মোতালেব সর্দারের চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। বাবার বহুবিবাহের কারণে এক প্রকার ঘরহীন হয়েই কেটেছে ছেলেবেলা। স্মৃতিজুড়ে শিশুশ্রমের কষ্ট বয়ে বেড়ানো বাবলু খোলা কাগজকে বলেন, ‘ছোটকালে পেটে ভাতে কষ্ট করেছি। পরের বাড়ি খেটেছি। বাপ একেকটা বিয়ে করে আর আলাদা হতে থাকে সবকিছু। একটু ভাতের জন্য কত কী করেছি।’ জীবিকার সন্ধানে নেমে অক্ষরজ্ঞানের সুযোগটাও মেলেনি। নিজের কোনো জমি ছিল না নিরক্ষর বাবলুর। কিন্তু জটিল জীবনকে সহজ করার রহস্য তার জানা। জীবনের দীর্ঘ সময় অন্যের জমিতে সবজি চাষের অভিজ্ঞতা তার। উৎসাহ দেখে এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে বিনামূল্যে আবাসিক এলাকার পতিত জমিতে সবজি আবাদের সুযোগ করে দেন। খুব দ্রুতই পরিচিতি পান সবজি চাষির।
আবিষ্কারের নেশা বাবলুকে দেখিয়েছে পথ। পতিত এক বিঘা জমিতে ঢেঁড়শ গাছ লাগান তিনি। এক পর্যায়ে ঢেঁড়শের গাছ থেকে কয়েকটা নিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। পনেরো দিন পরে দেখতে পান, ভেজানো ঢেঁড়শ গাছ থেকে মিলেছে সোনালি আঁশ। সেই আঁশ বাজারে বিক্রি করে লাভবান তো হয়েছেনই আবার হস্তশিল্প বানিয়েও ব্যাপক সাড়া ফেলেও দিয়েছেন।
সেদিনের ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আনন্দজড়ানো কণ্ঠে বাবলু বলেন, ‘ভেজানো ঢেঁড়শ গাছ থেকে যখন সুন্দর পাট হয়েছে তখন এত ভালো লেগেছে বলার মতো নয়। এরপর থেকে মাথায় নানা ভাবনা আসতে থাকে। একবার ধানের পাশে নিমপাতা রেখে দেখলাম পোকামাকড় তেমন বিরক্ত করে না। নিমপাতাও ভিজিয়ে দিয়েছি। দেখি কী হয়! সপ্তাহ খানেক ভেজানোর পর সেই নিমপাতার রস স্প্রে মেশিনে ভরে ধানের ওপর ছিটিয়ে দেখি পোকামাকড় আর নেই! এরপর হাতের পাশে আতা পাতা ভিজিয়েও একই রকম ফল পেলাম। বাজারে কীটনাশকের যে দাম সেটা কেনার মতো টাকা তো আমার নেই। তাই এটা দিয়েই কাজ চলত আমার।’
দিন দিন আবিষ্কারের নেশা বাড়তে থাকে বাবলুর। এরপর বেগুন গাছে টমেটোর ডগা কেটে কলম করে এক গাছেই দুই সবজি ফলিয়েছেন। বাবলু বলেন, ‘কলম করার মাস খানেক পর দেখি সবুজ গাছের এক ডগাতে ঝুলছে বেগুন, অন্য ডগাতে ঝুলছে লাল লাল টমেটো। এলাকার মানুষ তো অবাক! নিজের চোখে দেখতে অনেকে আসেন। যখন তারা দেখলেন, বেগুন গাছের গোড়া মাটিতে থাকলেও টমেটো গাছের গোড়া মাটিতে নেই, অবাক হয়ে তারা ঘটনা জানতে চান। তখন অনেক ভালো লাগে।’
বাবলু এখন চেষ্টা করছেন পেঁপে গাছে কুমড়ো ফলানোর। এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। তবে সফল হবে এটা তার বিশ্বাস। এক সন্তানের জনক বাবলুর ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য এখনো নিজের উদ্ভাবনী মন আর হাড়ভাঙা খাটুনিতেই সীমাবদ্ধ।
২০১২ সালে জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত উদ্ভাবনী মেলায় ২৫ স্বশিক্ষিত উদ্ভাবকের একজন নির্বাচিত হন। কিন্তু পুরস্কারের আড়াই লাখ টাকা ২০১৯ সালেও তার হাতে এসে পৌঁছায়নি। আক্ষেপের সুরে অনুরোধ করেন বাবলু, ‘আমি মূর্খ কৃষক। তাদের ডাকে অনেক কষ্টে ঢাকা শহর গেছি। স্বাক্ষর দিলাম। ব্যাংকে একাউন্ট করালো তারপরও হাতে টাকা আসেনি। খালি হাতে সাহস করে কাজ শুরু করেছিলাম। এখনো করে যাচ্ছি। আমার টাকাটা পাইয়ে দিন।’
বাবলু কোম্পানি চাষি হিসেবে সফল। সমাজের প্রয়োজনে তার উদ্ভাবনী মনকে আরও সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহার করা জরুরি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কাম্য।