নিখোঁজের সন্ধানে স্বজন
ছাইফুল ইসলাম মাছুম
🕐 ১০:৫১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
নিখোঁজ প্রিয়জনের সন্ধানে দিনভর অপেক্ষায় ছিলেন স্বজনরা। কারও খোঁজ মিলেছে, কারও মিলেনি! কেউ আগুনে পুড়ে কাতরাচ্ছেন বার্ন ইউনিটে, কেউ লাশ হয়ে পড়ে আছেন মর্গে, কেউ আবার এখনো নিখোঁজ। পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর নিহতের ঘটনা যেমন রয়েছে, আহতও হয়েছে অনেকে। নিখোঁজের সংখ্যাও কম নয়। উদ্ধার কাজ পরিচালনাকারী সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আহত ও নিহতের পরিসংখ্যান জানালেও নিখোঁজের সংখ্যা পুরোপুরি নির্ণয় করতে পারেনি কেউ। গতকাল দুপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করে জানিয়েছেন নিহতের সংখ্যা ৮১ জন, আহত ৪৫ জন।
অগ্নিকাণ্ডে আহত, নিহত কিংবা নিখোঁজ মানুষেরা কারও ভাই, কারও প্রিয় সন্তান, কারও বন্ধু। দুর্ঘটনাকবলিত এলাকায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই প্রিয় মানুষের খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠেন আত্মীয়-স্বজন। তারা ছুটতে থাকেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে, হাসপাতালে, কোথায় মিলবে প্রিয় মানুষের খোঁজ।
চকবাজারের পান সিগারেট ব্যবসায়ী আলমগীর। আগুন লাগার ১০ মিনিট আগে নিজ দোকান আলমগীর স্টোর থেকে ভাত খাওয়ার জন্য ছেলেকে পাঠিয়েছেন বাসায়। অগ্নিকাণ্ডের সময় দোকানের পানির টাংকিতে আশ্রয় নিয়ে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে ফিরলেও ছেলেকে ফিরে পাননি এখনো। তিনি খোলা কাগজকে জানিয়েছেন, তার নিখোঁজ ছেলের নাম পারভেজ। মেডিকেল মর্গে খোঁজে এখনো সন্ধান পাননি ছেলের।
এমন নিখোঁজের সংখ্যা অনেক। ওই এলাকার বাসিন্দা মাহিরকে খুঁজে পাচ্ছে না তার পরিবার। ভাইকে খুঁজতে ঢাকা মেডিকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বোন নূর এ আনহা। নিখোঁজ রয়েছেন জহির উদ্দিন নামের একজন। জহিরের খোঁজে ঢামেকে এসেছে তার ভাগ্নে রিফাত নেওয়াজ। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে জহির উদ্দিনের দোতলা বাড়ি। ভাই আব্দুর রহিমকে খুঁজে পাচ্ছেন না ইসমাইল হোসেন। ছেলে এনামুল হককে খুঁজছেন স্টেশনারি দোকান ওয়াসিফ এন্টারপ্রাইজরে মালিক আমজাদ হোসেন।
গতকাল ঢামেক মর্গে প্রিয় স্বজনদের খোঁজে আহাজারি করতে দেখা গেছে অনেককে। বৃদ্ধ মমতাজ বেগম তার নাতির খোঁজ পেয়ে এসেছেন মর্গে। কম বয়সে নাতি নয়নের (২৪) এমন মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না তিনি। নাতির শোকে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়েন মমতাজ। রোশনী আক্তার মর্গে এসেছেন চাচা গাজি মিয়া ও ভগ্নিপতি মুজিবরের খোঁজে। চাচা ছিলেন চকবাজারের ব্যবসায়ী আর ভগ্নিপতি ছিলেন শ্রমিক। চাচাকে সহজে শনাক্ত করতে পারলেও ভগ্নিপতিকে শনাক্ত করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। রোশনী আক্তার খোলা কাগজকে বলেন, ‘বোনের জামাইকে খুঁজে বের করতে অনেক কষ্ট হয়েছে, কারণ তার দুই পা ছাড়া পুরো শরীর পুড়ে গেছে। পরে পায়ের চিহ্ন দেখে আমরা শনাক্ত করি।’
চকবাজারের হোন্ডা পার্টস ব্যবসায়ী নিখিল (২৭)। দুই বন্ধুর লাশের খোঁজ পেয়ে মর্গে এসেছেন তিনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই বন্ধুর একজনের নাম আরাফাত আর অন্যজন রোহান। বন্ধুদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন নিখিল। নিখিল জানান, ‘দুর্ঘটনাস্থলে বাইকে করে পার হচ্ছিলেন তারা, বিস্ফোরণের সময় তাদের বাইকও বিস্ফোরিত হয়। ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়।’
অনেক মানুষকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটেও নিখোঁজ প্রিয় স্বজনকে খুঁজতে দেখা গেছে। স্বজনদের সুবিধার্থে কর্তৃপক্ষ দেয়ালে টাঙিয়েছে আহত চিকিৎসাধীনদের তালিকা। আঁখি তার স্বামী সেলিম ব্যাপারীকে (৪৪) খুঁজে পেয়েছেন ঢামেক বার্ন ইউনিটে। চকবাজারের আগুনে সেলিম ব্যাপারীর শরীরের ১৪ শতাংশ পুড়ে গেছে।
ভয়াবহ আগুন দুর্ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা নাঈম। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘চোখের সামনে অনেক মানুষকে মরতে দেখেছি। তখন রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল, হঠাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ১০ সেকেন্ডে আগুন ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে, মসজিদও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা খুব আতঙ্কে ছিলাম, কারণ তখন মসজিদে ৩০ জন শিশুসহ ৪৫ জন মানুষ অবস্থান করছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিচিত অনেকে এখনো নিখোঁজ আছে।’