ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রাসায়নিকের গন্ধ ভস্মস্তূপে

সুলতান মাহমুদ
🕐 ১০:৩৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯

প্রয়াত কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার বিখ্যাত ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে লাশের মিছিল এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী নানা অসঙ্গতির চিত্র এঁকেছিলেন। কিন্তু তিনি কী জানতেন তার এই কবিতার শিরোনাম কোনো এক শহীদ দিবসের প্রথম প্রহরে অন্য কোনো মর্মান্তিক ঘটনার খবরের শিরোনাম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এমন ঘটনাই ঘটলো রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় নন্দকুমার দত্ত সড়কে। সেখানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন সেখান থেকে শুধু পোড়া লাশের গন্ধ আসছে। নিঃশ্বাস নিতে গেলেই দুর্গন্ধে চোখে জল আসে। আর নিখোঁজদের স্বজনরা এই বাতাসেই নাক পেতে খুঁজে ফিরছে প্রিয়জনের চিরচেনা শরীরের ঘ্রাণ। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই বৃথা হয়েছে। কারণ, তাদের প্রিয়জন পুড়ে মারা গেছে। তাদের শরীরের পোড়া গন্ধ তো তাদের চেনা নয়। সেখান থেকে শুধু শরীরের পোড়া গন্ধই নয়, আসছে রাসায়নিকের গন্ধও। নিহতদের বেশির ভাগই সড়কে চলাচলরত অবস্থায় এবং শাটার বন্ধ করে দেওয়া দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভেতর আটকা পড়ে মারা যান। প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা এই তথ্য জানিয়েছেন।

আজিজুল ইসলাম নামে এক ফায়ারম্যান জানান, ভাই আমাদের কথা বলা নিষেধ আছে। তারপরও বলছি ‘আগুন লাগা ভবনটির নিচতলার মার্কেটের করিডরের শেষ মাথা থেকে একসঙ্গে ২৪টি লাশ উদ্ধার করি আমরা। তাদের অধিকাংশকেই দেখে চেনার উপায় নেই। বডিগুলো পুড়ে গেছে। দেখে মনে হয়েছে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তারা দৌড়ে গিয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ ছাড়া আশপাশের দোকান ও রেস্টুরেন্ট থেকেও লাশ উদ্ধার করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন জানান, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় রানা টেলিকম, বিপরীতে হাবিব টেইলার্স, হায়দার ফার্মেসিসহ আশপাশের সব দোকান সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাটার বন্ধ করে দেয়। সবাই ভেবেছিল শাটার বন্ধ করে দিলে আগুন থেকে বাঁচতে পারবে। কিন্তু আগুনের তীব্রতা বাড়ার কারণে সেখানেই পুড়ে মারা যান তারা। তাদের লাশ উদ্ধার করে মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে।

নূর আলম নামে আরেক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিস্ফোরণের পর একটি দেয়াল ভেঙে তার মাথায় লাগে, তিনি ড্রেনে পড়ে যান। কিন্তু তার জ্ঞান থাকায় সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন। তিনি আরও জানান, ওই রাস্তায় রাজমহল ও উল্টোদিকের হোটেলে যারা ছিল তারাও সেখানেই মারা গেছেন। হোটেলের মধ্যে অনেক লোক ছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, দুই দিন আগে এখানে (ওয়াহেদ ম্যানশনে) ১৪ কোটি টাকার কেমিক্যাল (পারফিউম জাতীয় ও প্লাস্টিক জাতীয়) পণ্য আনা হয়েছিল। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে কেমিক্যালের দাহ্য পদার্থের মাধ্যমে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। যে যেখানে ছিলেন সেখানেই তার মৃত্যু হয়। বাবার পাশে ছেলে এক রিকশায় বসা থাকলেও বাবা ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি। আগুনে পুড়ে ছেলে মারা যায় আর বাবা দগ্ধ হন।

চকবাজারের চুরিহাট্টা মোড়টি একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সড়কে দুটি পিকআপ ভ্যান, একটি প্রাইভেটকার, অসংখ্য রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, মোটরবাইক, ঠেলাগাড়ি পুড়ে গেছে। এ ছাড়া ভেঙে পড়া কংক্রিটের দেয়াল, প্লাস্টিকের দানা, পারফিউমের ক্যান পড়ে রয়েছে। চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে কয়েক কোটি টাকার পারফিউম মজুদ করা ছিল। যেগুলো এক ধরনের দাহ্য পদার্থ। ওই গোডাউনে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং দ্রুত এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার সময় চুড়িহাট্টা মোড়টি যানজটে ঠাসা ছিল। এ কারণে রাস্তাতেই অনেকে পুড়ে মারা গেছেন।

গতকাল বুধবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার থানার চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের সামনে একটি পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আশপাশের ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১১ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গতকাল দুপুরে তারা উদ্ধার কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করে ফায়ার সার্ভিস। দগ্ধসহ আহত অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে উদ্ধার কাজের ঘটনা সমাপ্ত ঘোষণা করেন।

অন্ধকারাচ্ছন্ন চকবাজার যেন মৃত্যুপুরী
অগ্নিকাণ্ডের পরপরই চকবাজার থানা থেকে শাহী মসজিদ এলাকায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছিল। রাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির লাল-নীল আলো আর হুইসেলে চকবাজার যেন পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে। আগুনের ভয়াবহতা এতটাই বেশি ছিল যে, শুধু বাড়ি-ঘরে নয়, রাস্তায় যানজটে আটকে থাকা মানুষজনও মৃত্যু থেকে রেহাই পায়নি। এলাকাবাসী জানায়, সিলিন্ডার অথবা ট্রান্সফরমার বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর রাস্তার পাশে থাকা মানুষগুলোর প্রাণ আগে ঝরেছে।

 
Electronic Paper