ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শহরের সেবা যাবে গ্রামে

আ.লীগের ২১ দফার ইশতেহার

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১১:০৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৮

গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে গ্রাম-শহরের বৈষম্য ঘুচানো, তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর, আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা, দারিদ্র্য নির্মূল এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির অঙ্গীকারসহ ২১ দফার ইশতেহার ঘোষণা করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। টানা ১০ বছরের ক্ষমতাকালে দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য, জীবনমান, অবকাঠামো উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের সূচকে বিশ্বে সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। গত দুই মেয়াদের এসব সাফল্যকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের ইশতেহার ঘোষণা করল।

মঙ্গলবার সকাল ১০টায় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ ইশতেহার ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি গত ১০ বছরের ধারাবাহিকতা এবং অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে সম্পৃক্ত করার প্রতিশ্রতি ব্যক্ত করেন। বলেন, টানা তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেলে তার দল ‘টেকসই বিনিয়োগ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’ নিশ্চিত করবে।
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘দিনবদলের সনদ’ শিরোনামে ইশতেহার দিয়ে ব্যাপক জনসমর্থন পায় আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তরুণ ভোটারদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিলে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সে নির্বাচন নানা কারণে বর্জন করেছিল সে সময়ের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ফলে আওয়ামী লীগসহ মহাজোট ১৫৪ আসনে বিনা ভোটে জয়লাভ করেছিল। সে নির্বাচন ‘বিতর্কিত’ আখ্যা পেলেও তার ধকল কাটিয়ে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতাকাল শেষ করে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। এবারও নির্ধারিত সময়ে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ নির্বাচন। এবার আওয়ামী লীগের ইশতেহারের প্রতিপাদ্য বা শিরোনাম-‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। গত ১০ বছরের নানা অর্জন, সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি ও আগামী ৫ বছরের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে সাজানো হয়েছে দলটির ৮০ পৃষ্ঠার ইশতেহার। সে ইশতেহারের শুরুতেই তারা ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার তুলে ধরেছে। সেগুলো হচ্ছে- প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ; তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর; কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ; নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা ও শিশু কল্যাণ; পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা; সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল; মেগা প্রজেক্টগুলোর দ্রæত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন; গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা; দারিদ্র্য নির্মূল; সর্বস্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি; সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি; সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা; সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা; আধুনিক কৃষি-ব্যবস্থার লক্ষ্য যান্ত্রিকীকরণ; দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন; জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা; ব্লু-ইকোনমি-সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন; নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা; প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও অটিজম কল্যাণ; টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন।
লিখিত ইশতেহারে বলা হয়েছে, বিভেদ, হানাহানি, জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস, অবরোধ বিশৃঙ্খলার রাজনীতি আওয়ামী লীগ চায় না। গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। আবার ক্ষমতায় যেতে পারলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতি নির্মূল এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে সুসংহত করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে এ ইশতেহারে। রয়েছে সমাজের সব পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতি। সেবামুখী দক্ষ জনপ্রশাসন ও জনহিতৈষী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তুলে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও রয়েছে এতে।
ইশতেহারের মূল লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সর্বজনীন মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করা হবে। নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পেলে আগামী ৫ বছরে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে জনবল নিয়োগ করা হবে। জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির প্রতি আমাদের দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত থাকবে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলদারি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হবে। আগামী ৫ বছরে জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৫ হাজার ৪৭৯ ডলারেরও বেশি। প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করব। শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেব। আগামী ৫ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। পাকা সড়কের মাধ্যমে সব গ্রামকে জেলা-উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।  প্রতিটি উপজেলায় ‘যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপন করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের তথ্য সংবলিত একটি ইন্টিগ্রেটেড ডাটাবেজ তৈরি করা হবে। তরুণদের সুস্থ বিনোদনের জন্য প্রতিটি উপজেলায় গড়ে তোলা হবে একটি করে ‘যুব বিনোদন কেন্দ্র’। প্রতিটি জেলায় একটি করে ‘যুব স্পোর্টস কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলা হবে। আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মসৃজন করার পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। প্রতি উপজেলা থেকে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার যুব/যুব মহিলাকে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। বাল্যবিয়ে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করবেন তারা। নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আলাদা ব্যাংকিং ও ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। দারিদ্র্যের হার ১২.৩ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজনের নিয়মিত রোজগার নিশ্চিত করা হবে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে। সহজ শর্তে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে আয়বর্ধকমূলক কর্মকাÐে সম্পৃক্ত করা হবে। ছোট ও মাঝারি আকারের দুগ্ধ ও পোলট্রি খামার প্রতিষ্ঠা এবং মৎস্য চাষের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রয়োজনমতো ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও নীতি সহায়তা বৃদ্ধি করা হবে। ২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হবে। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে আধুনিক শিল্পনগরী গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আইটি শিল্প পার্ক স্থাপন করা হবে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে ১০০টি উপজেলায় এ ধরনের ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলছে। নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গ্রেডসহ শিক্ষা খাতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে বৈষম্য রয়ে গেছে, তা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিরসন করা হবে। ১ বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ওপরে সব নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে। সব বিভাগীয় শহরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের মধ্যে বুলেট ট্রেন চালু করা হবে। দেশের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলো আধুনিকায়ন করা হবে। আগামী ৫ বছরে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে। মহাসড়কের পাশে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আন্ডারপাস/ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করার জন্য যমুনা নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ করা হবে। দেশের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা, ইতিহাস বিকৃতি রোধ এবং প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধকালে বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিতকরণ, শহীদদের নাম-পরিচয় সংগ্রহ এবং স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির যেসব ধারা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চর্চায় সাংবাদিকদের উৎসাহ প্রদান ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

 
Electronic Paper