সমুদ্রসীমা জয় ও ছিটমহল
প্রতিবশী সম্পর্কে দৃষ্টান্ত
রহমান মুফিজ
🕐 ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৮
৪৭ বয়সী বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পর থেকেই নানা মাত্রিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগুতে হয়েছে। পুনর্গঠনের প্রথম পর্বেই দেশি-বিদেশি ঘাতকরা নৃশংসভাবে হত্যা করে দেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উল্টোপথে চলতে থাকে দেশ। এ দেশের মানুষকে ফের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুগপৎ লড়াই করতে হয়েছে।
এর মধ্য দিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ যেখানে পৌঁছেছে সেখান থেকে দাঁড়িয়ে যখন তার অর্জনের খাতা খুলে দেখে সেখানে অর্জনের পাল্লাই ভারী। সেসব অর্জন বিশ্বের বুকে স্বতন্ত্র ও সম্মানজনক অবস্থান তৈরিতে রেখেছে রেখেছে যুগান্তকারী ভূমিকা। এর মধ্যে সমুদ্রসীমা বিজয় এবং ৬৮ বছরের মানবিক সংকটপূর্ণ ছিটমহল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বের দৃষ্টান্ত।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বিরোধ ছিল। এ নিয়ে দ্বিপক্ষীয়ভাবে কোনো ধরনের নিষ্পত্তি না আসায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের অক্টোবরে আন্তর্জাতিক সালিশী আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। সমুদ্র আইনবিষয়ক জাতিসংঘের কনভেনশন (আনক্লস) মেনেই ইটলসে ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর মামলাটি দাখিল করা হয়। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশের পক্ষে রায় আসে।
এ রায়ে উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রসীমায় বাংলাদেশ তার অধিকার বুঝে পায়। এ বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমায় বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকায় মৎস্য, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ খনন, উত্তোলন ও ব্যবহারের অধিকার অর্জিত হয়। এর পাশাপাশি ৪৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপান এলাকা বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকার অর্জিত হয়।
মিয়ানমারের ২০১৪ সালে এবার ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হয় নেদারল্যান্ডসের হেগের সালিশী আদালতে। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশ পায়। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি সুরাহা হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৭-এর দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ১৬২টি ছিটমহল সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ সিরিল র্যাডক্লিফ সীমানা নির্ধারণের সময় ভারতের ভেতর বাংলাদেশ বাংলাদেশের ভেতর ভারতের গুচ্ছ গুচ্ছ জনপদ রেখে দেয়। সেটা পরবর্তীতে সৃষ্টি করে এক মানবিক সমস্যা। ভারতের অভ্যন্তরে ছিল বাংলাদেশের ১১১ ছিটমহল আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিল ভারতের ৫১ ছিটমহল।
বাংলাদেশ অংশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ৪৩৩ জন। আর ভারতের ৫১টি ছিটমহলের লোকসংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। এসব মানুষের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। ৬৮ বছর ধরে দেশ পরিচয়হীন শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ নানা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এ মানুষকে নাগরিক পরিচয় দান এবং মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দেয় ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি।
২০১৫ সালের ১ আগস্ট রাত ১২টা ১ মিনিটে দুই দেশ ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আওতায় একে-অন্যের অভ্যন্তরে থাকা নিজেদের ছিটমহলগুলো পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করে। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম মানবিক সমস্যার সমাধান ঘটে। বাংলাদেশের আরেকটি বড় ধরনের কূটনৈতিক বিজয় ঘটে এ চুক্তির মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, বাস্তবায়নের পর ভারতের অভ্যন্তরের ১১১টি ছিটমহলের ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর ভূমি বাংলাদেশের সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।