সমস্যার বৃত্তে সম্ভাবনার চিংড়ি
জাফর আহমদ
🕐 ১০:৪২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১০, ২০১৮
সম্ভাবনা থাকলেও উদ্যোগের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি। প্রতিবছরই কমছে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ। রপ্তানিকারকরা বলছেন, উন্নত জাতের চিংড়ি চাষ করতে না পারায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় কম উৎপাদন হওয়া ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কারণে চলমান বাজারই ধরে রাখা যাচ্ছে না।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছর চিংড়িসহ অন্যান্য মৎস্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের। জুলাই-অক্টোবর চার মাসে শুধু চিংড়ি রপ্তানির কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১২৪ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন ডলারের। রপ্তানি হয়েছে ১৫৭ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলারের। এটা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ কম। আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ২০৩ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলারের হিমায়িত চিংড়ি।
হিমায়িত চিংড়ির সঙ্গে ভেজাল পণ্য মেশানোর কারণে রপ্তানি কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, সম্প্রতি ব্রাসেলস সফরকালে শুনে এসেছি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া হিমায়িত চিংড়ির সঙ্গে এসব ভেজাল পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়ে মোহাম্মদ হাতেমের তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন। তার মতে, বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি নিয়ে যে অপপ্রচার করা হয় তা এনজিওর প্রচারণা। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, দেশে চিংড়ি উৎপাদন কমে যাওয়া, উৎপাদন খরচ বেশি হওয়া, স্থানীয়ভাবে চিংড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারার কারণে চিংড়ি রপ্তানি কমে যাচ্ছে। হিমায়িত মৎস্য রপ্তানিকারক সমিতির এই সহ-সভাপতি বলেন, উন্নত জাতের চিংড়ি চাষ শুরু করে উৎপাদন বৃদ্ধি করা না গেলে আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি শূন্যের কোটায় নামবে। আর তা হলে হিমায়িত চিংড়ি চাষ ও রপ্তানিকে কেন্দ্র করে দেশে যে কয়েক হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো তৈরি হয়েছে তা ধ্বংস হয়ে যাবে।
ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চিংড়ি রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো, দেশের চিংড়ি হ্যাচারিগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়া। বাংলাদেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোগ্রাম বাগদা চিংড়ি উৎপাদন হয়। আর চিংড়ি রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর প্রতি হেক্টর জমিতে চিংড়ি উৎপাদন হয় প্রায় সাত হাজার কিলোগ্রাম। এর ফলে দেশের চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিংড়ি সংগ্রহ করতে হচ্ছে বেশি দামে। একই চিংড়ি ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ সংগ্রহ করছে কম দামে। ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। আন্তর্জাতিক বাজারের ধাক্কায় রপ্তানির জন্য বাংলাদেশে হিমায়িত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ৭৮টি কারখানার মধ্যে ইতিমধ্যে ৫০টি বন্ধ হয়ে গেছে। চালু আছে মাত্র ২৮টি কারখানা। এর মধ্যে খুলনাঞ্চলের ৫৮টির মধ্যে ২৪টি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২০টির মধ্যে মাত্র চারটি কারখানা চালু আছে।
তথ্য অনুযায়ী, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি চিংড়ি রপ্তানিকারক দেশ দক্ষিণ আমেরিকার ভেনামি নামে উচ্চফলনশীল জাতের চিংড়ি চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছে। এ জাতের চিংড়ি প্রতি হেক্টর উৎপাদন হয় প্রায় সাত হাজার কেজি। পরিবেশের প্রশ্ন তুলে সরকার বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি দিচ্ছে না। অথচ প্রতিবেশী ভারত ভেনামি জাতের চিংড়ি চাষ করে তিন বছরে বিশ্বের মোট চিংড়ি রপ্তানি সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশে নিয়ে গেছে।