অপচয় ১২৫ কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:১৩ অপরাহ্ণ, মে ১৭, ২০১৮
চলতি দশম জাতীয় সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশন পর্যন্ত কোরাম সংকটের কারণে নষ্ট হয়েছে ১৫২ ঘণ্টা ১৭ মিনিট। যার অর্থমূল্য ১২৫ কোটি ২০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫৫ টাকা। এই হিসাব দিয়েছে জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
২০১৭ সালে সংসদের (চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ অধিবেশন) কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে নিজেদের কার্যালয়ে গবেষণা প্রতিবেদন ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ প্রকাশ করে টিআইবি। এতে বলা হয়েছে, গত বছর ওই পাঁচটি অধিবেশনে ৭৬ কার্যদিবস অধিবেশন চলে, যার মধ্যে ৩৮ ঘণ্টা তিন মিনিট অপচয় হয়েছে কোরাম সংকটে। প্রতি কার্যদিবস হিসেবে গড়ে অপচয় হয়েছে ৩০ মিনিট। এর আর্থিক মূল্য ৩৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৩৮ টাকা। প্রতি মিনিট হিসেবে যা দাঁড়ায় এক লাখ ৬৩ হাজার ৬৮৬ টাকা।
উল্লেখ্য, সংসদ বিধি অনুযায়ী, অধিবেশন শুরুর জন্য অন্তত ৬০ জন সংসদ সদস্য উপস্থিত থাকতে হয়। আর এই উপস্থিতিকে বলা হয় কোরাম। সংসদের ৬০ জন সদস্য উপস্থিত না থাকলে অধিবেশন বসতে পারে না। আর এর ফলেই সৃষ্টি হয় কোরাম সংকট।
সংসদের কাজে সংসদ সদস্যদের অবহেলার কারণে এ অপচয় হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বরাবরের মতো এবারও সংসদে কোরাম সংকট অব্যাহত ছিল। এটা সংসদ কার্যক্রমে সংসদ সদস্যদের আগ্রহের কমতি ও ঘাটতির পরিচয়, যা খুবই উদ্বেগজনক।’
অশালীন ভাষার ব্যবহার হয়েছে ১৩ ঘণ্টা
দশম জাতীয় সংসদের চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ অধিবেশনে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১৭) মোট ব্যয় হওয়া ২৬০ ঘণ্টা ৮ মিনিটের মধ্যে অশালীন ভাষার (আক্রমণাত্মক, কটু ও অশ্লীল শব্দ) ব্যবহার হয়েছে ১৩ ঘণ্টা। আর এতে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৭৫ হাজার ৮০ টাকা।
প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের একাংশ কর্তৃক অশ্লীল শব্দের ব্যবহার অব্যাহত ছিল। যার মোট ব্যয় হওয়া সময়ের ৫ শতাংশ, যা সংসদীয় বিধির লক্সঘন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও নাগরিক সমাজের একাংশের বিরুদ্ধে এসব আক্রমণাত্মক অশালীন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।’
বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালন করেন না এরশাদ
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূতের দায়িত্বে থাকলেও চার বছরে তাকে কোনো দায়িত্ব বা ভ‚মিকা পালন করতে দেখা যায়নি। প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করেছে টিআইবি। অথচ পদের কারণে প্রটোকলসহ প্রতি মাসে তার পেছনে ব্যয় হচ্ছে সাড়ে ৫ লাখ টাকা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিশেষ দূত হিসেবে সরকারি প্রটোকল (নিরাপত্তা, গাড়ি, সচিব ইত্যাদি) পাচ্ছেন। একই সঙ্গে মন্ত্রীর পদমর্যাদার সমতুল্য বিশেষ ভাতা ও অন্যান্য খাত বাবদ স্বাস্থ্যসেবা, ইন্সুরেন্স, বিদেশ ভ্রমণ, টেলিফোন বিল) ইত্যাদি বাবদ প্রতি মাসে সাড়ে ৫ লাখ টাকা সরকারের ব্যয় হচ্ছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা সত্তে¡ও গত চার বছরে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে ব্যক্তিগত সফর করলেও বিশেষ দূত হিসেবে কোনো ভ‚মিকা তাকে পালন করতে দেখা যায়নি।’
আইন প্রণয়নে সময় ব্যয় কম
টিআইবির হিসাবে ২০১৭ সালের পাঁচটি অধিবেশনে মোট ২৪টি সরকারি বিল পাস হয়। এক্ষেত্রে মোট প্রায় ২৩ ঘণ্টা ২৮ মিনিট সময় ব্যয় করা হয়, যা অধিবেশনগুলোর ব্যয়িত মোট সময়ের ৯ শতাংশ।
বিলের ওপর আপত্তি, বিলের ওপর জনমত যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব এবং দফাওয়ারী সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় মোট ২৬ জন সদস্য ৩৩% সময় আলোচনা করেন। এই সময়ের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল ৯৩.৫% সময় অংশগ্রহণ করেন।
বিলের খসড়ায় জনমত যাচাই-বাছাইয়ের সব প্রস্তাব নাকচ হওয়ার কারণে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণের চর্চা এখন সীমিত বলে টিআইবির পর্যবেক্ষণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিলের ওপর আপত্তি, সংশোধনী, জনমত যাচাই-বাছাই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে সরকারদলীয় সদস্যসহ প্রধান বিরোধী দল এবং অন্যান্য বিরোধী সদস্যদের অংশগ্রহণ থাকলেও তা কয়েকজন সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আইনের ওপর আলোচনায় মোট সদস্যদের মাত্র ৭% সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন। বিল উত্থাপন, বিলের ওপর সংসদ সদস্যদের আলোচনা এবং মন্ত্রীর বক্তব্যসহ একটি বিল পাস করতে সময় লেগেছে গড়ে প্রায় ৩৫ মিনিট।
এ বিষয়ে সুলতানা কামাল বলেন, ‘আইন প্রণয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর এখানেই সবচেয়ে কম সময় ব্যয় হচ্ছে।’ ইফতেখারুজ্জমান বলেন, ‘আমাদের এখানে আইন প্রণয়নে সময় লাগে ৩৫ মিনিট। আর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আইন প্রণয়নে সময় লাগে ২৩৫ মিনিট।’
‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ এখনো
২০১৫ সালে সংসদকে ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ আখ্যায়িত করে সরকারি ও বিরোধী দলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তবে বৃহস্পতিবার নতুন প্রতিবেদন দেওয়ার সময়ও তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেছেন, তাদের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করলেও সরকারের মন্ত্রিসভায় তাদের অন্তর্ভুক্তি অর্থাৎ সরকারে তাদের দ্বৈত অবস্থান এবং দশম সংসদের প্রায় চার বছরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দলের আত্মপরিচয় সংকটের কারণে তাদের ভ‚মিকা প্রশ্নবিদ্ধ।’
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘জবাবদিহিতা নিশ্চিত, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সংসদের ভ‚মিকায় ঘাটতি রয়েছে। প্রত্যাশিত ভ‚মিকা পালনে সংসদ ব্যর্থ হয়েছে।’