ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নালিতাবাড়ীতে হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী ঐতিহ্য-সংস্কৃতি

এম. সুরুজ্জামান, নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি
🕐 ১০:৩১ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৭, ২০২১

নালিতাবাড়ীতে হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী ঐতিহ্য-সংস্কৃতি

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকাজুড়ে কোচ ও গারো আদিবাসী সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করছে। ৩২৭ দশমিক ৬১ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট নালিতাবাড়ী উপজেলায় ১টি পৌরসভা, ১২টি ইউনিয়ন, ২টি খ্রিস্টান মিশন, ১টি আদিবাসী কমিউনিটি সেন্টার ও ১৯৯টি গ্রামে ২ লাখ ৫১ হাজার ৮২০ জন লোকের বসবাস।

 

এ উপজেলায় ১২টি ইউনিয়নে ৭৮টি গ্রামে সহস্রাধিক পরিবারে প্রায় ৪০ হাজার আদিবাসী মানুষ নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে আদিকাল থেকেই বসবাস করে আসছে। এসব আদিবাসীদের অন্যতম হলো গারো, হাজং, কোচ, ডালু, বানাই, হদি, বর্মণ ও রাজবংশি। এসব সম্প্রদায়ের রয়েছে আলাদা কৃষ্টি সংস্কৃতি ও আলাদা সমাজ ব্যবস্থা। গারোরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আর কোচ ও হাজং সম্প্রদায়ের লোকজন সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। গারো আদিবাসীরা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত পরিবার। গারোদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো বড়দিন। এছাড়াও প্রতিবছর ষ্টার সানডে, তীর্থ উৎসব, ইংরেজি নববর্ষ ও ওয়ানগালা উৎসব পালন করে থাকে। কোচদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব হলো দুর্গাপূজা ও কালিপূজা। আদিবাসীদের ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও এ দুই সম্প্রদায়ই আরও অলাদা আলাদা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কালের বিবর্তনে বর্তমান ডিজিটাল যুগে এসব গারো, হাজং ও কোচ আদিবাসীদের হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই তাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারি-বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

সূত্রে জানা গেছে, নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী পানিহাটা, তাড়ানি, ফেকামাড়ি, মায়াঘাসি, নাকুগাঁও, দাওধারা, আন্ধারুপাড়া, খলচান্দা, বুরুঙ্গা, বাতকুচি, সমেশ্চুড়া, খলিসাকুড়ি, গাছগড়া, নয়াবিল এলাকায় কোচ ও গারো আদিবাসীদের বসবাস। অনাদিকাল থেকেই এসব এলাকায় বাপ-দাদার বসতভিটায় আদিবাসীরা বসবাস করে আসছে। চলমান পৃথিবীতে বিশ্বের সব মানুষের জীবনমান বাড়লেও আবিাসীদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। বরং তাদের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।

আদিবাসী নেতা মি প্রদীপ জেং চাম বলেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে আছে (আদিবাসীদের ভাষায়) মান্দিদামা, ক্রাম, খোল, নাগ্রা, জিপসি, খক, মিল্লাম, স্ফি, রাং, বাঁশের বাশি, আদুরী নামের বাদ্যযন্ত্র ও পোশাক দকবান্দা, দকশাড়ী, খকাশিল, দমী, রিক মাচুল। আর কোচ আদিবাসীদের পোশাক রাংঙ্গা লেফেন ও আছাম। আর খাদ্যের তালিকায় আছে বাঁশের কোঁড়ল আর চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি খাবার উপকরণ ‘মিয়া’, কলাপাতায় করে ছোট মাছ পোড়া দিয়ে খাওয়া, যার নাম ‘ইথিবা’, মুরগির বাচ্চা পুড়ে বাঁশের চোঙ্গায় ভরে পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খাওয়া, যার নাম ব্রেংআ, মিমিল, কাঁকড়া, শামুক ও শুকরের গোস্ত, চালের তৈরি মদ যার নাম চু আর কোচ আদিবাসীদের কাঠমুড়ি ইত্যাদি খাবার উপকরণ এখন প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।

সীমান্তবর্তী খলচান্দা গ্রামের কোচ আদিবাসী পরিমল কোচ বলেন, আমরা বন-পাহাড়ে যুদ্ধ করে অসহায় জীবন যাপন করে আসছি। তাই পেটের তাগিদে ইতিহাস ঐতিহ্য বুঝি না, শুধু বুঝি বেঁচে থাকতে হবে। নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য কোচদের আছে ‘কোচভাষা’ আর গারোদের আছে ‘আচিক’ ভাষা। বর্তমানে এই দুই ভাষাতেও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের নিজস্ব ভাষার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা জুড়ে দিয়ে কথা বলে থাকেন।

এ ব্যাপারে আদিবাসী সংগঠন ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের (টিডব্লিউএ) চেয়ারম্যান মি লুইস নেংমিনজা জানান, আদিবাসীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি সংরক্ষণে নালিতাবাড়ীতে আমরা কালচারাল একাডেমি স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

 
Electronic Paper