ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সাকিবের ছুটি ও বিসিবির অসহায়ত্ব

সাহাদাৎ রানা
🕐 ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২১

সাকিবের ছুটি ও বিসিবির অসহায়ত্ব

দেশ তোমাকে কী দিয়েছে
সেটা বড় কথা নয়,
দেশকে তুমি কী দিয়েছ
সেটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের অমর বাণী এটি। আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির বিখ্যাত বাণী রয়েছে দেশ বিষয়ে-‘তোমার দেশ তোমার জন্য কী করেছে তা জিজ্ঞেস করো না, নিজেকে জিজ্ঞেস করো তুমি তোমার দেশের জন্য কী করতে পেরেছ।’

এই দুজন বিখ্যাত মানুষের বাণী থেকে এটা স্পষ্ট নিজের প্রাপ্তির চেয়ে দেশের জন্য কিছু করতে পারা অনেক বেশি বড় কিছু। যখন কোনো মানুষের দেশের জন্য কোনো কিছু করার সুযোগ সৃষ্টি হয় তিনি তা সবার আগে করার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। অবশ্য দেশের জন্য সরাসরি কিছু করার সুযোগ অনেকের সামনে আসে না, ভাগ্যও হয় না। তবে যাদের সামনে আসে তারা নিশ্চিতভাবে তা করতে ব্যাকুল হয়ে উঠবেন এটাই স্বাভাবিক। অন্তত দেশপ্রেমিক নাগরিকদের জন্য তা মহান দায়িত্ব হিসেবে বর্তায়। প্রায় সব পেশার মানুষের জন্য কম-বেশি দেশের হয়ে কিছু করার সুযোগ আসে। তবে যারা খেলোয়াড় তাদের সামনে সেই সুযোগটা অনেক বেশি। দেশের হয়ে খেলতে পারলে দেশকে কিছু দেওয়া সম্ভব হয়। যারা খেলাধুলা করেন তাদের সব সময়ই স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলের হয়ে খেলে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। দেশের জাতীয় পতাকাকে হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। কেননা, দেশের হয়ে খেলার চেয়ে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য বড় কিছু আর হতে পারে না। দেশের হয়ে খেলে দেশকে সাফল্য এনে দিতে পারা সব খেলোয়াড়ের জন্যই সৌভাগ্যের, স্বপ্নের বিষয়। এতে রয়েছে এমন এক আনন্দ, যে আনন্দের কোনো পরিমাপ হয় না। আর তখন দেশের মানুষের কাছে খেলোয়াড়রা হয়ে ওঠেন জাতীয় বীর, দেশের নায়ক।

ভূমিকাতে এত কথা বলার প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ করলে তা আরও স্পষ্ট হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন সব সময়ের আলোচিত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েছে জাতীয় ক্রিকেট দল। সেখান থেকে ছুটি নিয়েছেন সাকিব। তার এই ছুটি নেওয়াটা যৌক্তিক। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য তিনি ছুটি নিয়েছেন। এক্ষেত্রে বিসিবি তাকে এই কারণে ছুটি দিয়ে কোনো ভুল করেনি। তবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলার কারণে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাকিব। আগামী এপ্রিল ও মে মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত হবে এবারের আইপিএল। এবার কলকাতা নাইট রাইডার্স তিন কোটি ২০ লাখ রুপিতে কিনে নিয়েছে সাকিবকে। আইপিএল যখন চলবে ঠিক তখন বাংলাদেশ সফরে আসবে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল। এর জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে ছুটিও চেয়েছেন সাকিব। সাকিব যে সময়ের জন্য ছুটি চেয়েছেন ঠিক সেই সময়ে হবে টেস্ট ম্যাচ। বিসিবিও সাকিবের আবেদন মঞ্জুর করেছে।

এখন আইপিএল খেলার জন্য শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলা হবে না সাকিবের। প্রশ্ন হলোÑ সাকিবের কাছে কেন দেশের হয়ে খেলার চেয়েও বড় হলো আইপিএলে খেলা? সহজ সরল উত্তর, অর্থের ছড়াছড়ি। জাতীয় দলের হয়ে খেলে যে অর্থ পাবেন সাকিব তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি টাকা পাবেন আইপিএলে। তার মানে সাকিবের কাছে দেশের চেয়েও বড় হলো অর্থ? অথচ জাতীয় দলে খেলে আজ সাকিব, বিশ^ ক্রিকেটের কাছে সাকিব আল হাসান হয়েছেন। জাতীয় দলে খেলার কারণে আইপিএল তাকে কোটি কোটি টাকায় কিনতে চায়। যে জাতীয় দলে খেলে সাকিব, সাকিব হয়ে উঠলেন এখন সেই জাতীয় দলে খেলা বাদ দিয়ে টাকার জন্য ভিনদেশি ফ্রাঞ্চাইজিতে খেলবেন এটা কি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? না, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের হয়ে না খেলে ঠিক সেই সময়ে টাকার জন্য অন্য টুর্নামেন্ট খেলবেন তা মেনে নেওয়া যায় না। এটা একজন দেশপ্রেমিক খেলোয়াড়ের সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না।

সাকিব দেশের জন্য সম্পদ। তবে একদিনে এমন সম্পদ সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড দীর্ঘ সময় ধরে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আজকের সাকিবকে তৈরি করেছে। সাকিব নিঃসন্দেহে প্রতিভাবান ক্রিকেটার। তবে এখানে প্রতিভার সঙ্গে বিসিবির পরিচর্যার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বিসিবি যদি সাকিবের ঠিকমতো পরিচর্যা না করত তবে হয়তো সাকিব, কখনো সাকিব হয়ে উঠতেন না। সঙ্গে সাকিব সৃষ্টি হয়েছেন দেশের কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসায়ও।

এখন বিশ^ তারকা হয়েই নিজের মতো করে চলবেন তাও হতে পারে না। এখন বোর্ডের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের ইচ্ছায় যেখানে খুশি খেলবেন তা মেনে নেওয়া যায় না। সাকিব আমাদের দেশের ক্রিকেটের জন্য সম্পদ। বাংলাদেশের হয়ে সাকিব আল হাসানের খেলা না খেলার প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠছে এ কারণে যে, সাকিবের ভালো পারফরম্যান্স আমাদের জন্য স্বস্তির খবর হয়। সাকিব দলে থাকলে শক্তি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সাকিবের অনুপস্থিতি খারাপ ফলাফল নিয়ে আসে। গত কয়েকটি সিরিজের দিকে দৃষ্টি দিলে তা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্প্রতি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে দুর্দান্ত খেলেছেন সাকিব। যদিও ইনজুরির কারণে শেষ টেস্টে খেলতে পারেননি তিনি। সাকিবকে ছাড়া স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল হতাশার। অন্য যেকোনো ক্রিকেটারের চেয়ে সাকিবের গুরুত্ব বেশি এ কারণে যে তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। সাকিব দলে থাকলে বাংলাদেশের জয় পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি উজ্জ্বল হয়। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে- তবে কি সাকিবের কাছে বাংলাদেশের জয়ের চেয়ে বেশি বড় আইপিএল খেলা? তবে এখানে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের সময় সাকিব ইনজুরিতে পড়লেও ইনজুরির কারণে সাকিব কখনো আইপিএল মিস করেননি। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও সত্যি!

আইপিএলে খেলার জন্য শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলতে না চাওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বিসিবি তাকে ছুটি দিয়ে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রমাণ করেছে। অবশ্য শুরুতে বিসিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বিসিবির চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটার দেশের হয়ে না খেলে আইপিএল বা অন্য কোনো টুর্নামেন্টে খেলতে চাইলেও তাদের নাকি কিছুই করার নেই। বিসিবির এমন যুক্তি সত্যিই হাস্যকর। বিসিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কেউ খেলতে না চাইলে তাকে জোর করে খেলানো যায় না।

সেক্ষেত্রে তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ পারফরম্যান্সটা পাওয়া যাবে না। তাই বিসিবি সাকিবকে ছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিসিবির যুক্তি ঠিক আছে। কিন্তু বিসিবি কি একবারও সাকিবের কাছে জানতে চাইতে পারত না, সাকিব কি দেশের জন্য খেলেন না অর্থ বা নিজের জন্য খেলেন? বাস্তবতা হলো, সাকিবের ইস্যু বর্তমানে সামনে এলেও ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ^কাপের পর সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে বিসিবির দূরত্ব বাড়তে থাকে। এর আগেও সাকিব একাধিকবার ছুটি নিয়েছেন। বিসিবি ছুটি দিতে বাধ্য হয়েছে বললেও ভুল হবে না। শুধু সাকিব নয়, অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার বিভিন্ন সময়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো ছুটি নিয়েছেন। বিসিবি তখনো কিছু করেনি বা তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। এখনো দৃষ্টান্তমূলক কিছু করা হলো না। এখন সমস্যার বিষয় হলো সিনিয়রদের দেখিয়ে দেওয়া পথে যখন জুনিয়ররাও হাঁটবে তখন সঙ্কট আরও বেড়ে যাবে।

সাকিবের ছুটির বিষয়টি সামনে আসার পর চারদিকে সমালোচনা শুরু হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে বিসিবি। ২২ ফেব্রুয়ারি বিসিবির পক্ষ থেকে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মিডিয়াকে জানিয়ে দেওয়া হয় কেউ ইচ্ছে করলে জাতীয় দল ছেড়ে দিতে পারবে। ইচ্ছা করলে তিন সংস্করণের যেকোনো একটিতে খেলতে পারবেন। জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় চুক্তির ক্ষেত্রে কোন ক্রিকেটার কোন ফরম্যাটে খেলবেন, তা লিখিতভাবে জানাতে হবে বোর্ডকে। কেউ ইচ্ছে করলে কোনো সিরিজ শুরুর আগে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারবে না। এ বিষয়ে শীঘ্রই নতুন চুক্তি করবে বিসিবি। তখন কেউ ইচ্ছে করলেই ছুটি নিয়ে যেখানে সেখানে খেলতে যেতে পারবে না। কেন্দ্রীয় চুক্তি নিয়ে বোর্ড নতুন পরিকল্পনা করছে। যেখানে ক্রিকেটারদের নিয়ে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে বিশ্বাস বোর্ডের। বোর্ড আগামীতে আরও কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। ভবিষ্যতে নয় এখন সাকিব ইস্যুতে বিসিবিকে আরও কঠোর হতে হবে। দেশের কোনো সিরিজ মিস দিয়ে অন্য কোনো ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট খেলতে দেওয়া উচিত হবে না। এখনই বিসিবির উচিত হবে আইপিএলে সাকিবের খেলা বন্ধ করে দেওয়া। সবার সামনে যা হবে উদাহরণ। যাতে আগামীতে জুনিয়র ক্রিকেটাররা সতর্ক হয় এসব বিষয়ে।

সাকিব আমাদের দেশের জন্য যেমন স্বস্তির নাম, তেমনি সাকিবকে নিয়ে অস্বস্তির বিষয়টিও পুরনো। সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সবসময়ই আলোচিত নাম। ভক্তদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে সমালোচিত। এছাড়া রয়েছে নিয়ম না মানার অসংখ্য উদাহরণ। ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাকিব আল হাসানকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল আইসিসি। এটা ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য বড় ধরনের একটা ধাক্কা। বিশেষ করে সাকিব আল হাসানের মতো অপরিহার্য ক্রিকেটারের ক্ষেত্রে। তারপর সাকিবকে ছাড়া বাংলাদেশ এক বছর খেলেছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাকিব দলের জন্য অপরিহার্য হলেও চিরস্থায়ী নন। বাস্তবতা হলো, কোনো একদিন সাকিব অবসর নেবেন। সাকিবের মতো প্লেয়ারকে ছাড়াই তখন খেলতে হবে আমাদের। তাই সাকিবকে অপরিহার্য মনে না করে বোর্ডের উচিত আরও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া। যাতে ভবিষ্যতে কোনো ক্রিকেটার এমন আচরণ না করতে পারেন। কেন্দ্রীয় চুক্তি নিয়ে বোর্ডের নতুন এই পরিকল্পনা, ক্রিকেটারদের পুরনো সমস্যা কতটা সমাধান করবে, তা সময়ই ভালো বলবে। তবে ক্রিকেটের স্বার্থে বিসিবির আরও কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। যারা দেশের হয়ে খেলার চেয়ে অর্থের জন্য ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট খেলতে বেশি আগ্রহী তাদের নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে।

সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper