ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল : বেদনার কাব্য

প্রণব রায়
🕐 ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ০৪, ২০২০

বাংলাদেশ। নামটির পরিচয়ে যে দেশীয় সম্পদসমূহ উল্লেখ করা হয় পাট তার মধ্যে অন্যতম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে যে পণ্যটি সর্বাধিক গুরুত্ব রেখেছিল তা হচ্ছে পাট। তাই তো পাটকে বলা হয় বাংলাদেশের স্বর্ণসূত্র। বর্তমানে বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল রয়েছে।

এ পাটকলগুলোতে স্থায়ী ও অস্থায়ী শ্রমিক রয়েছে প্রায় ষাট হাজার। অর্থাৎ প্রায় ষাট হাজার পরিবার এ মিলগুলোর ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক বিশ্ব মন্দার হাওয়া যখন বাংলাদেশেও লেগেছে, সরকারি প্রণোদনাপ্রাপ্ত যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মী ছাঁটাইয়ের তোড়জোড়, ঠিক সেই সময়েই বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ঘোষণা যেন তাদের জন্য উৎসাহ বাণী, হোক না বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী সেটা এক বছর আগের নেওয়া সিদ্ধান্ত। মন্ত্রী বলেছেন ক্রমাগত লোকসানের কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্রমাগত লোকসানের জন্য দায়ী কে সরকারি সিদ্ধান্ত ও অব্যবস্থাপনা নাকি শ্রমিক। বিজেএমসির মতো প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকা এ মিলগুলো দিনের পর দিন লোকসান দিয়েছে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার জন্য। এখানে শ্রমিকদের দোষ কোথায়? পাট ক্রয়ে দুর্নীতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, রপ্তানিতে উদাসীনতা এসব কারণে দিন দিন লোকসানের পরিমাণ বৃদ্ধিই পেয়েছে। অসাধু কর্মকর্তাদের দুর্নীতির মা ন শুল দিচ্ছে নিরীহ শ্রমিকরা, আর অসাধু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারি দুর্নীতির দায় বহন করে করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগকালে অন্য সকল প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের সঙ্গে পাটকল শ্রমিকের কর্মহীন হওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পদক্ষেপও বটে। তাছাড়া বিদেশে পাটের বাজার খোঁজা পণ্যের বহুমুখীকরণ ইত্যাদি পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং বিজেএমসির কাজ।

কোনো ক্রমেই এই লোকসানের দায় শ্রমিকের নয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি মতবিনিময় সভায় পাটমন্ত্রী নিজেই দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে লোকসানের কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। এটা পরিষ্কার যে লোকসানের কারণগুলো সরকার জানত এবং জেনেশুনেই এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। পাট শিল্পের লোকসানের কারণগুলো দীর্ঘ ৪০ বছরেও সমাধান হয়নি। তাই শ্রমিক ছাঁটাই না করে পাটকল পরিচালনা কেন্দ্র বিজেএমসির অযোগ্য প্রশাসন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ছাঁটাই, পাট ক্রয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করার প্রতি নজর দেওয়া উচিত।

আজ যেখানে চলতি অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ যার মধ্যে পাটকলগুলোর উৎপাদিত মূল পণ্য পাট সুতা ৩৩ শতাংশ এবং পণ্য ৬ শতাংশ। এসব রপ্তানির ৮০ শতাংশই রয়েছে বেসরকারি পাট কলের দখলে। বিজেএমসির অযোগ্য কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও সরকারি ভ্রান্ত নীতির ফলে বাংলাদেশের স্বর্ণ সূত্র ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে আসাটা কোনো ষড়যন্ত্র কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। মৌসুমে জুলাই-আগস্ট মাসে পাটের দাম যখন ১০০০-১২০০ টাকা থাকে তখন পাট না কিনে সেপ্টেম্বর অক্টোবরে যখন পাটের দাম ২০০০-২২০০ টাকা হয় তখন পাট ক্রয় করা হয় এবং তা ক্রয় করা হয় চাহিদার থেকে কম।

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসায়নের দ্বারা মিলগুলোকে বর্তমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিকায়ন করা হবে। ২০১৪ সালের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের পরবর্তী সময় থেকে অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের (৮৯৫৪ জন) প্রাপ্য সকল বকেয়া এবং বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকদের (২৪৮৮৬ জন) প্রাপ্য বকেয়া মজুরি, শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি এবং সেই সঙ্গে গ্র্যাচুইটির সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ হারে অবসায়ন সুবিধা একসঙ্গে শতভাগ পরিশোধ করা হবে। এজন্য সরকারি বাজেট থেকে প্রদান করা হবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুর্যোগকালে সরকারের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তে ব্যক্তি মালিকানা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো উৎসাহিত হবে। একইভাবে তারা তিনগুণ শ্রমিক ছাঁটাই করবে যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে টাকা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের পেছনে খরচ হবে সেই টাকা দিয়ে পাটকলের পুরনো যন্ত্রাংশ সংযোজন করে পাটকলগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে চালু রাখা যেতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ সৃষ্টি, এদেশের সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পাট চাষ, পাট শিল্প এবং পাটজাত দ্রব্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

 ৫০ লক্ষ পাট চাষি, পাট শ্রমিক, পাট ব্যবসায়ীসহ প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। গত দশ বছরে পাটকলগুলোকে লাভজনক ভাবে পরিচালনার বিষয়ে সরকার, বিজেএমসি, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের দফায় দফায় যে আলোচনা হয় তাতে লোকসান এবং দুর্নীতি বন্ধে মৌসুমে যথাসময়ে কাঁচা পাট ক্রয় করা, কারখানা পরিচালনা ব্যয়ে দুর্নীতি বন্ধ, পণ্য মোড়কে ‘পাট ব্যবহার আইন ২০১০’ প্রণয়ন, পাট কলগুলোকে আধুনিকায়ন করা, পাটের ব্যবহার বহুমুখীকরণসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং সে অনুযায়ী সরকার অর্থও বরাদ্দ দেয়, কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তির হীন স্বার্থ রক্ষায় সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে পাটকলগুলোকে অচল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়।

আজকের এই সিদ্ধান্ত সেই ষড়যন্ত্রেরই প্রতিফলন। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীর গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের প্রস্তাব সমর্থন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। গণবিরোধী এ সিদ্ধান্তে স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিক, পাটচাষি ও তাদের পরিবার, পাট ব্যবসায়ী মিলে প্রায় তিন কোটি মানুষ চরম বিপাকে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি ভেবে দেখেছেন কি? যখন বিশ্বব্যাপী পলিথিনের বিকল্প বিবেচনায় পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে পাটের কদর বাড়ছে, এই শিল্পের বাজার তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেই মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত কতখানি সঠিক তা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। গত দশ বছরে যখন সারা পৃথিবীতে প্লাস্টিক সামগ্রীর বিপরীতে পরিবেশ বান্ধব পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগানো হয়নি, বরং তাদের আয় কমে যায়।

 মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিজেএমসি, মিল ব্যবস্থাপনা ও ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনা সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজরাই পাটকল লোকসানের সুবিধাভোগী। তাই বলা যায়, এই লোকসান পরিকল্পিত। তাছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর হাতে যে জমি আছে সরকার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের মধ্যে তা বিতরণ হতে পারে এমন মন্তব্যও উঠে এসেছে এই সিদ্ধান্তের পর। এই করোনাকালে কর্মহীন হয়ে যাওয়া দক্ষ শ্রমিকরা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কাজের সুযোগ পাবেন কিনা তাও নিশ্চিত নয়। পেলেও বেতন ভাতা অনেক কমে যাবে।

এতগুলো পরিবারকে অনিশ্চয়তায় রেখে সরকারের গৃহীত এ সিদ্ধান্ত কখনোই জনবান্ধব হতে পারে না। এই সিদ্ধান্তে যেমন পাটকল শ্রমিকরা ক্ষতির সম্মুখীন তেমনি পাট উৎপাদনকারী কৃষকরাও অল্প দামে পাট বিক্রয় করতে বাধ্য হওয়ার আশঙ্কাও বাড়বে। এর ফলে বেসরকারি পাটকলগুলো সিন্ডিকেট সৃষ্টির মাধ্যমে কাঁচাপাটের বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পেয়ে যাবে। করোনাকালে যখন পরিবেশবান্ধব শিল্প প্রতিষ্ঠার তাগিদ বাড়ছে তখন সরকার পরিবেশবান্ধব পাট শিল্প সংকুচিত করে পরিবেশবিধ্বংসী শিল্প প্রতিষ্ঠার পেছনে বিশাল বাজেট বরাদ্দ করেছে।

অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার জন্য সারা বিশ্ব যখন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করছে তখন সরকারের প্রায় ষাট হাজার পরিবারের অন্নসংস্থানের পথ রুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হঠকারিতাই বটে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলেছেন, সরকারি পাটকলে লোকসানের কারণ দেখেন না সেখানে কেন শত শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে এবং কাদের কারণে তা হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। এতদিন এই লোকসানের দোহাই দিয়ে শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো থেকে বঞ্চিত করা হলেও বিজেএমসি এবং সংশ্লিষ্ট কারখানার কর্মকর্তারা যথারীতি নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন-ভাতা আদায় করেছেন। মূল কথা হল, স্বাধীনতার পর থেকেই বিজেএমসির কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের আখের গোছাতে যত ব্যস্ত ছিলেন, কারখানাগুলো লাভজনক করার ক্ষেত্রে ততটাই নিস্পৃহ ছিলেন।

ফলে দিনে দিনে বিজেএমসি হস্তিতে রূপ নিয়েছে। বিজেএমসির মতো হাতি পোষার জন্য আজ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের বলি হতে হচ্ছে। করোনাকালে দেড় কোটি কর্মহীন শ্রমিকের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরো ষাট হাজার শ্রমিক। প্রধানমন্ত্রীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং পাটের জন্য আন্দোলন করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাটকলে সৃষ্ট কোনো সমস্যা মোকাবেলায় নিজেই ছুটে গেছেন তিনি। পাটকল শ্রমিকদের তিনি দেখেছেন নিজ সন্তানের মতোই। সেই পাট শিল্পই আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। আজ তার সুযোগ্য কন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী।

অন্তত বাঙালি জাতি হিসেবে এই স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রায় ষাট হাজার শ্রমিকসহ প্রায় তিন কোটি মানুষকে অনিশ্চয়তার পথে তিনি ঠেলে দেবেন না এই বিশ্বাস করতে চাই। পাট খাতে যে লোকসান হয়েছে তার জন্য শ্রমিকরা কোনোভাবেই দায়ী নয়। গত ৪৮ বছরে সরকারকে এই পাট খাতে ১০৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে, এজন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হল পাটকল বন্ধের। অথচ এক ওয়াট বিদ্যুৎ না কিনে গত দশ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। পাট খাতও রাষ্ট্রায়ত্ত আর সব খাতের মতো প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে লোকসানে পড়েছে। আর সেই ব্যর্থতার মূল্য দিচ্ছে শ্রমিকরা। এই চাকরিচ্যুতির আগেও দফায় দফায় তাদের রাস্তায় নামতে হয়েছে বকেয়া মজুরির দাবিতে।

আজ বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এই রাষ্ট্র কঠোর পরিশ্রম করা শ্রমিকদের মজুরি দিনের পর দিন বাকি রেখেছে। আজ তাদের ওপরেই নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এই বিপর্যয় নেমে আসছে তাদের পরিবারের ওপর কারণ এই শ্রমিকদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের পরিবারের খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বাসস্থানের ঝুঁকি। তাই এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আমাদের স্বর্ণসূত্র পাটকে স্বমর্যাদায় ফিরিয়ে আনবে; সরকারের কাছে এটাই প্রত্যাশা।

প্রণব রায় : কলাম লেখক

 

 
Electronic Paper