লবণ বন্যা সহিষ্ণু ধানের জীবন রহস্য উন্মোচন
গবেষণায় নতুন দিগন্তের সূচনা
আলতাফ হোসেন
🕐 ৬:১০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৬, ২০২১

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উপকূলীয় এলাকায় আকস্মিক বন্যা ও লবণাক্ততা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ধান চাষ ব্যাহত হচ্ছে। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কার্যকরী উপায় হচ্ছে লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ধানের উন্নত জাত উদ্ভাবন। এ লক্ষ্যে বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী এক দশক ধরে কাজ করে চলেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় দেশে প্রথমবারের মতো লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ধানের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (বিনা) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বিজ্ঞানীরা। এতে করে ধান গবেষণায় নতুন দিগন্তের সূচনা হবে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
বিনা তার প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই আরোপিত মিউটেশনের মাধ্যমে ফসলের নানা জাত উদ্ভাবন করেছে। এসব গবেষণায় আরোপিত মিউটেশনের প্রভাবে ফসলের ফেনোটাইপের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন দেখে উন্নত জাত শনাক্ত করা হতো কিন্তু জিনোমের কোথায় ডিএনএ বিন্যাসের পরিবর্তনের জন্য এমন কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হলো তার ব্যাখা প্রদান করা সম্ভব হতো না। এ লক্ষ্যে ২০১৯ সালে এই গবেষণায় প্যারেন্ট ও নির্বাচিত তিনটি মিউট্যান্ট ধানের জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন হয় যা বাংলাদেশে প্রথম।
জানা গেছে, দেশের দুই মিলিয়ন হেক্টর জমি লবণাক্ত, যেখানে বছরে একটি ফসল হয়। খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই করতে ও ভবিষ্যতে খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সরকার লবণাক্ত, হাওরসহ প্রতিকূল এলাকায় বছরে ২-৩টি ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দিচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ জিনোম উন্মোচনের ফলে লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু জাতের ধান উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ সহজতর হবে।
বিনা এ ধানকে একদিকে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকার জন্য জাত হিসেবে (বিনাধান-২৩) ছাড়করণের লক্ষ্যে নানামুখী গবেষণা পরিচালনা করেছে, অন্যদিকে পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার করে আরোপিত মিউটেশনের মাধ্যমে এ ধানের কৌলিতাত্ত্বিক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। এ গবেষণায় বিভিন্ন মাত্রার গামা রেডিয়েশন প্রয়োগ করে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক মিউট্যান্ট সৃষ্টি করে তা থেকে নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এমসিক্স জেনারেশনে তিনটি উন্নত মিউট্যান্ট শনাক্ত করা হয়েছে। প্রাপ্ত মিউট্যান্টগুলো প্যারেন্ট অপেক্ষা উন্নত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, লবণাক্ততা ও ১৫ দিন জলমগ্নতা সহিষ্ণু।
সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য চাহিদা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিরিক্ত এ মানুষগুলোর খাদ্য চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত ফসলের জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে কেবল সবার খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব। বিনা ও বাকৃবির সমন্বয়ে উদ্ভাবিত ধানের এ জিনোম সিকোয়েন্সের ফলে লবণাক্ত ও হাওর এলাকায় ধানের উৎপাদন আরও বাড়বে। গবেষণাটিকে যাতে দ্রুত মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেটি নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করবে।
গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম, বাকৃবির পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্যা ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহিদুল ইসলাম, বিনার প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামছুন্নাহার বেগম ও পিএইচডি শিক্ষার্থী মানস কান্তিশাহা।
ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, সাধারণত বিনা উদ্ভাবিত জাতগুলোতে বিভিন্ন রেডিয়েশন প্রয়োগের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন করা হয়। তবে এ রেডিয়েশনের প্রভাবে জিনের কি ধরনের পরিবর্তন হয় তা আগে জানা সম্ভব হতো না। আমাদের এ উদ্ভাবনের ফলে এখন থেকে যে কোনো ধানের জাতের জিন পর্যায়ে কী ধরনের পরিবর্তন হয় তা নিশ্চিতভাবে জানা যাবে।
গবেষণা সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মো. বজলুর রহমান মোল্যা বলেন, বিনা উদ্ভাবিত বিনাধান-২৩ একটি লবণাক্ত ও বন্যা সহিষ্ণু ধানের জাত। ২০১৯ সালে বাকৃবি ও বিনার গবেষকবৃন্দের প্রচেষ্টায় বিনাধান-২৩ ও তা থেকে উৎপন্ন তিনটি মিউটেন্ট (রেডিয়েশন দ্বারা প্রভাবিত জাত) ধানের জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন করা হয়। যা বাংলাদেশে প্রথম। এ জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবনের ফলে দেশে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে।
এর ধারাবাহিকতায় ওই ধানের জাতে আমরা প্রতিকূল আবহাওয়া সহিষ্ণু ২৩টি জিন, উচ্চ ফলনশীল বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী ১৬টি জিন এবং চালের আকার-আকৃতির জন্য দায়ী চারটি জিন শনাক্ত করতে পেরেছি। এ গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে ধানের শনাক্তকৃত জিনগুলো পরে দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীরা রেফারেন্স জিনোম হিসেবে ব্যবহার এবং ধানের উচ্চফলনশীল জাতে স্থানান্তর করতে পারবেন।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
