ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শাড়ির সুনাম টাঙ্গাইল জামদানি

মহব্বত হোসেন, টাঙ্গাইল
🕐 ১২:৩৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০২১

শাড়ির সুনাম টাঙ্গাইল জামদানি

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বী বসাক সম্প্রদায় আদি তাঁতি, অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায় গোত্রের লোক। এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে আসে। মুর্শীদাবাদ থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে ঢাকার ধামরাই। এখানে আবহাওয়া ও কাঁচামালসহ সবকিছু অনুকূলে থাকায় কালক্রমে তারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে

‘নদী চর খাল বিল-গজারির বন’ টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন। এ মন্ত্রকে সামনে নিয়ে যুগ যুগ ধরে এগিয়ে চলছে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি। এর সঙ্গে সুনামও ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে। আর ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির জগতে সুনাম ধরে রাখার চেষ্টা করছে জামদানি। যে কোনো অনুষ্ঠানেই বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। বিশেষ করে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির প্রতি রয়েছে তাদের আলাদা টান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুদক্ষ কারিগররা মেধা আর মনন দিয়ে নানা বৈচিত্র্য আর নতুনত্বের বাহারি ডিজাইলের শাড়ি তৈরি করে থাকে সারা বছর। এসব শাড়ি দেশের প্রান্ত ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে।

টাঙ্গাইলের ১২ উপজেলার মধ্যে টাঙ্গাইল সদর, দেলদুয়ার, কালিহাতী, গোপালপুর, ভুয়াপুর ও নাগরপুর হচ্ছে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির জন্য প্রসিদ্ধ। দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলশোধা, বাজিতপুর ও পুটিয়াজানি গ্রামের তাঁতের শাড়ির সুনাম এখন বিশ্বজুড়ে। এসব গ্রাম তাঁতের খটর খটর শব্দে যেন সারাদিনই মুখরিত থাকে। সূতি জামদানি, সপ্টসিল্ক, সূতি, ধানসিঁড়ি, বালুচুরি, গ্যাসসিল্ক, স্বর্নকাতান, দোতারি, চোষা, রেশম শাড়ি, স্বর্ণচূড়া, ইক্কাত, আনারকলি, দেবদাস, সানন্দ, নীলমবাড়ি, ময়ুরকন্ঠি মাসলাইস কটন, জুম শাড়ি, এন্ডি সিল্ক, সুতি এন্ডি, খেস শাড়ি, খাদি এবং সাধারণ শাড়ির মতো বাহারি ডিজাইনের তাঁতের শাড়ি তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীগুলোতে। এর মধ্যে জামদানি বা নরম যেমন সিল্ক, অর্ধসিল্ক, টাঙ্গাইল বি.টি., বালুচুরি, জরিপাড়, হাজরাবতী, সুতিপাড় ও কোটকি শাড়ির প্রচুর চাহিদা রয়েছে বাজারে। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শাড়ি বুনন করতে যেন অনেক সময় হিমশিম খেতে হয় তাঁতিদের। ঈদ কিংবা পূজা পার্বনে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দিনরাত পরিশ্রম করতে হয় তাদের।

তাঁতপল্লীর তাঁতি ও শাড়ি ব্যবসায়ীরা জানায়, টাঙ্গাইলে উৎপাদিত জামদানি শাড়ির মানসস্মত হওয়ার কারণে প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এ শাড়ির মূল আকর্ষণই হচ্ছে গুনগত মান আর নকশা। এমনিতেই তাঁতের শাড়ি তৈরি করতে হয় খুবই দরদ দিয়ে আর গভীর মনোযোগের সাথে। জামদানির ক্ষেত্রে আরো নৈপুণ্য আর ধৈর্যের প্রয়োজন পড়ে। একটি ভালো মানের জামদানি শাড়ি তাঁতিরা হাতে বুনন করার কারণে অনেক কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। আর সে কারণে জামদানির দামও অন্যান্য শাড়ির তুলনায় বেশি হয়ে থাকে। জামদানি শাড়ির হাতে বুননের কারণে শাড়ির ডিজাইন হয় খুবই নিখুঁত। বাজারে সচরাচর পাঁচশ’ টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার পর্যন্ত জামদানি শাড়ি পাওয়া যায়।

দেলদুয়ার উপজেলার বিখ্যাত তাঁতপল্লী পাথরাইল গ্রামের শাড়ি ব্যবসায়ী রাম প্রসাদ জানান, দফায় দফায় সুতা আর রংসহ শাড়ি তৈরির উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং শ্রমিকের স্বল্পতার কারণে এ শিল্প এখন অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। অপরদিকে মেশিনে তৈরি শাড়ির দাম তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে অনেক সময় হাতে তৈরি শাড়ির দিকে ঝুঁকে পড়ে ক্রেতারা। যদিও গুণগতমানের দিকে অনেক তারতম্য রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি দিন দিন যেন সংকটের মধ্যে পড়ছে। এছাড়াও রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ডিজাইন সেন্টার ও দক্ষ কারিগরের অভাব। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান ই-কমার্সেও টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। দিন দিন চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিক্রি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ই-কমার্সে টাঙ্গাইলের তাঁত পণ্যের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। অনলাইন ভিত্তিক শাড়ি বিক্রির প্রতিষ্ঠান গ্রীন ফ্যাশনের কর্ণধার মাকসুদা বেগম জানান, দেশ ও দেশের বাইরে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির চাহিদা ও বিক্রি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে কারণে এ ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ছে অনেকেই। টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি বিক্রি করে ঘরে বসেই প্রচুর অর্থ উপার্জনের যেন এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানীখ্যাত পাথরাইলের যজ্ঞেশ^র অ্যান্ড কোং-এর স্বত্বাধিকারী রঘুনাথ বসাক বলেন, দেশের দূরদূরান্ত থেকে নিয়মিত ক্রেতারা এসে শাড়ি নিয়ে যায়। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে ক্রেতা আসে দেলদুয়ারের তাঁতপল্লীতে। পাশের দেশ ভারতে প্রচুর চাহিদা থাকায় সেখানকার ব্যবসায়ীরা প্রচুর শাড়ি কিনেন ঈদা আর পূজায়।

টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি উদ্যোগে একটি তাঁতপল্লীর দাবি দীর্ঘদিনের। যদিও এখনো পর্যন্ত এ ব্যপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। টাঙ্গাইল শহরের বাজিদপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে তাঁতিদের ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করা। তবে আশার কথা হচ্ছে বাজিতপুরে তাঁতিদের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করার কাজ এগিয়ে চলছে।

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বী বসাক সম্প্রদায় আদি তাঁতি, অর্থাৎ আদিকাল থেকেই এরা তন্তুবায় গোত্রের লোক। এরা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে আসে। মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহী, রাজশাহী থেকে ঢাকার ধামরাই। এখানে আবহাওয়া ও কাঁচামালসহ সবকিছু অনুকূলে থাকায় কালক্রমে তারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় তাঁতিরা টাঙ্গাইলে এসে বসতিস্থাপন এবং তাঁতের কাজ শুরু করে। আর এভাবেই বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ তারা তাঁত বুনে আসছে।

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper