কুমিল্লায় বাণিজ্য ও কৃষিতে নবোদ্যম
কুমিল্লা প্রতিনিধি
🕐 ৩:১২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ০৩, ২০২১
কুমিল্লা অঞ্চলের অর্থনীতির আর্থিক কাঠামো, আয় কাঠামো, সম্পত্তি কাঠামো, পরিবার কাঠামো, জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য, মানুষের আচরণ এবং পেশার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। করোনাকালীন প্রায় স্থবির জনজীবনে কুমিল্লায় অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানান উত্থান-পতন ঘটেছে। সকল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লার অর্থনীতি। কুমিল্লায় জনজীবন এখন শতভাগ স্বাভাবিক। কৃষি-অকৃষি খাতে নবোদ্যমে চলছে সকল কর্মকাণ্ড।
কুমিল্লায় দুটি বড় সামাজিক সম্পদ আছে, এর একটি হচ্ছে মানুষ। যারা করোনার ভয়কে জয় করেছেন; ভয় পেয়ে ভড়কে যায়নি, সবকিছু বন্ধ করে দেয়নি। সরকার চেষ্টা করেও তাদের কর্মচাঞ্চল্য বন্ধ করতে পারেনি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এখানকার মানুষ ভোগ। তাই এখানকার অর্থনীতি চাঙ্গা রয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান কম হলেও এটি এখনো দেশের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
কারণ, শিল্প কিংবা পরিষেবা খাতের কোনো পণ্য বর্তমান বাজারে সরবরাহ কম থাকলেও তা বাজার অস্থিতিশীল করে না, কিন্তু কৃষিপণ্য বাজারে সরবরাহ কম থাকলে তা অতি দ্রুত অস্থিতিশীল করে দেয়। করোনাকালীন সময়ে কুমিল্লা অঞ্চলে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের পাশে অবস্থিত নিমসার কাঁচাবাজার থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সকল জেলায় স্বল্প সময়ে তরিতরকারি পৌঁছে যায়। এ অঞ্চলের অনেক মাটিতে এখনো নামমাত্র চাষে, বিনাসারে এবং কোনো প্রকার পরিচর্যা ছাড়াই ফসল উৎপাদনে সক্ষম।
দেশের খোরাকি অর্থনীতির অর্থকরী ফসল যেমন- কমলালেবু, মাল্টা, পেয়ারা ও বাতাবিলেবু কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে চাষ শুরু হয়েছে। এই অর্থনীতিকে যতই ছোট মনে করা হোক না কেন, যা অত্যন্ত দুর্ভিক্ষকে হারাতে স্বক্ষম। জনসংখ্যার বিরাট একটি অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ খাত দ্বারা উপকৃত হয়ে আসছে।
দেশের শিল্প খাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ থাকায় এ খাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। বড় বড় শপিংমল এবং দোকানপাট দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের প্রায় সকলেই ক্ষতির মুখে পড়েছিল। এই সংকটে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পুঁজি হারিয়েছে। কর্মচারীদের একটি অংশ পেশা পরিবর্তন করেছেন। তবে, শেষ পর্যন্ত যারা টিকে ছিল তারা এখন ভালোভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ধারণা ছিল, ‘বাংলাদেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ এর ব্যতিক্রম হয়েছে কুমিল্লায়। উদ্যোক্তা এবং সরকারের নানামুখী তৎপরতায় কোনোভাবেই অর্থনৈতিক কর্মকা- বন্ধ হয়নি কুমিল্লায়। করোনাকালীন মহামারীতে খাদ্যপণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হয়। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে তা সফল হয়নি।
বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা ‘কুমিল্লা ইপিজেড’। সাম্প্রতিক করোনার থাবায় আঘাত এসেছিল এখানেও। একে একে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায় সব কারখানা। স্বল্প সময়ের মধ্যেই আবার একে একে সব সচল হয়, কাজে ফেরে শ্রমিক। করোনা প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতার ফলে এখন পর্যন্ত সকলেই নিরাপদ। নানা আতঙ্কের ছাপ বয়ে জীবন বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে রাখতে স্বক্ষম হয়।
২৩৯টি শিল্প প্লটের মধ্যে দেশি-বিদেশি এবং যৌথ মালিকানাধীন ৪৯টি কারখানা এখন উৎপাদনে রয়েছে। চীন, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, ভারত, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, হংকং, মরিশাস, আয়ারল্যান্ড, ফ্র্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ওমান এবং বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তাগণের বিনিয়োগে তৈরি পোশাক, জুতা, ইয়ার্ণ, ফেব্রিক্স, টেক্সটাইল ডাইস ও অক্সিলিয়ারিস, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, সোফা কাভার, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, প্লাস্টিক পণ্য, মেডিসিন বক্স, আই প্যাচ, ক্যামেরা ব্যাগ, কম্পিউটার ব্যাগ তৈরি করা হয়। এই ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্য ইউরোপ, ব্রিটেন, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ১৩টি উন্নত দেশে প্রায় সাড়ে তিনশ’ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়ে আসছে। এখানে প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজারের মতো শ্রমিক এখন কর্মরত রয়েছেন।
শিক্ষা স্বাস্থ্যের জন্য খ্যাত কুমিল্লা দেশের রেমিটেন্সেও প্রথম। কয়েক লাখ পরিবার প্রত্যক্ষভাবে রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে দেশে ফিরেছে। এরা যে সবাই কপর্দকহীন হয়ে এসেছে এমনটি নয়। রেমিট্যান্সের প্রবাহ তুলনামূলক এখনো বেশ ভালো, যা তাদের পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার মুখরিত হয়ে উঠলেও কুমিল্লায় গত প্রায় দুই বছরে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঝরে বয়ে গেছে। এদের অনেকেই কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন। নারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ দাম্পত্যজীবনে প্রবেশ করেছেন। কৃষি খাতে দেশের শিকড় কাঠামো এবং অকৃষি খাতে স্বাস্থ্য কাঠামো ভেঙে যায়নি কুমিল্লায়।
করোনাকালে হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য চাষ, দুধ উৎপাদন ও শাকসবজি চাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক অবসরকালীন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং প্রবাসফেরত যুবকরা। উন্নয়ন বাজেটের ব্যয়, করোনায় বিশেষ প্রণোদনা-বিশেষ বরাদ্দ, দাতা সংস্থার অতিরিক্ত বরাদ্দ, করোনাকালেও শিক্ষকদের বেতন-বোনাস প্রাপ্তি এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন রকমের আয়, বর্ধিত রেমিট্যান্স ইত্যাদির টাকা চলে এসেছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মানুষের হাতে। এতে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা এতে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কুমিল্লায় কিন্ডারগার্টেনের মতো শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও ওই সকল প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। করোনাকালীন সময়ে কুমিল্লায় অবস্থিত হাসপাতাল খাত প্রচুর ব্যবসা করেছে।
করোনার খরা কাটিয়ে কুমিল্লার প্রত্নতত্ত্ব স্থান ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠছে। করোনার প্রভাবে দীর্ঘ প্রায় ১৯ মাস বন্ধ থাকার পর ঐতিহাসিক শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘরসহ সকল প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন খুলে দেওয়ার পর দর্শনার্থীর ভিড় বেড়েই চলছে। দেশ-বিদেশের নানা স্থান থেকে প্রতিদিন আসছে নানা বয়সের নারী-পুরুষ। এ সকল স্থানে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসায় এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হাজার হাজার কর্মজীবী মানুষের অর্থনীতির চাকা আবার সচল হয়েছে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228