আকিজ উদ্দিন
শূন্য থেকে শীর্ষতম শিল্পগোষ্ঠী
শিশির কুমার সরকার, বেনাপোল
🕐 ১২:০৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১
সাহস, সততা আর কঠোর পরিশ্রমকে পুঁজি করে শূন্য থেকে দেশের বৃহৎ শিল্প পরিবারের মালিক হওয়ার দৃষ্টান্ত আকিজ গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান আকিজ উদ্দিন। তিনি শৈশবে ভাগ্য-অন্বেষণে কলকাতায় পাড়ি জমান। একদিন সেখান থেকে ফিরে আসেন যশোরে। সেটা ১৯৫২ সাল। বন্ধুর বাবা বিড়ি ব্যবসায়ী বিধু ভূষণের সহযোগিতায় শেখ আকিজ উদ্দিন শুরু করেন বিড়ির ব্যবসা। পাশাপাশি তিনি ধান, পাট, নারিকেল ও সুপারি কিনে আড়তে আড়তে বিক্রি করেন। সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ির পাশে বেজেরডাঙ্গা রেল স্টেশনের কাছে একটি দোকান দেন। কিন্তু দোকানটি আগুনে পুড়ে যাওয়ায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।
সব হারিয়েও তিনি ভেঙে পড়েননি। তার বিশ^াস ছিল চেষ্টা করলে সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই সদয় হবেন। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের কাছে তার ভাষ্য ছিল- ‘সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে আমি আবার পথের ফকির হয়ে গেলাম! কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও মনোবল হারাইনি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, আবার শূন্য থেকে শুরু করব, উপরওয়ালা নিশ্চয়ই সদয় হবেন।’
পরবর্তীতে তিনি এলাকাবাসীর সহায়তায় ফের দোকান দিয়ে পাশাপাশি শুরু করেন ধান, পাট, চাল ও ডালের ব্যবসা। এরপর তিনি সুপারির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাত জেগে সেই সুপারি ছিলে কলকাতায় পাঠাতেন। এ কাজে সহযোগিতা করতেন তার সহধর্মিণী। সুপারির ব্যবসায় তার বেশ লাভ হয়। পরে ষাটের দশকে যশোরের সীমান্তবর্তী নাভারণ পুরাতন বাজারে নামকরা ব্যবসায়ী মোজাহার বিশ্বাসের সহায়তায় তিনি ছোট্ট একটি বিড়ি তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। আস্তে আস্তে অন্যান্য ব্যবসাতেও মনোনিবেশ করেন তিনি। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
তিনি বিখ্যাত আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেন। (সম্প্রতি এই কোম্পানিকে জাপান টোব্যাকো ১.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে নিয়েছে) একে একে তিনি আকিজ গ্রুপের ব্যানারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বেশ কয়েকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬০ সালে অভয়নগরে প্রতিষ্ঠা করেন এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড অত্যাধুনিক একটি চামড়ার কারখানা। ২০০৬ সালে ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একে একে প্রায় ২০টি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কোম্পানিগুলোর প্রতিটিই বাংলাদেশ ও দেশের বাইরের বাজারে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করা কোম্পানিগুলোর লিস্টটি দেখলেই ব্যাপারটি বোঝা যায়-
১. ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ (১৯৬৬)
২. আকিজ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (১৯৭৪)
৩. আকিজ ট্রান্সপোর্টিং এজেন্সি লিমিটেড (১৯৮০)
৪. জেস ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড (১৯৮৬)
৫. আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড (১৯৯২)
৬. আকিজ জুট মিল লিমিটেড (১৯৯৪)
৭. আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, একই বছর আকিজ টেক্সটাইল মিলস্ লিমিটেড (১৯৯৫)
৮. আকিজ পার্টিকল বোর্ড মিলস লিমিটেড (১৯৯৬)
৯. আকিজ হাউজিং লিমিটেড (১৯৯৭)
১০. সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (১৯৯৮)
১১. আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড (২০০০)
১২. আকিজ অনলাইন লিমিটেড (২০০০)
১৩. নেবুলা লিমিটেড (২০০০)
১৪. আকিজ করপোরেশন লিমিটেড (২০০১)
১৫. আকিজ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড টেকনোলজি লিমিটেড (২০০১)
১৬. আকিজ অ্যাগ্রো লিমিটেড (২০০৪)
১৭. আকিজ পেপার মিলস্ (২০০৫)
আকিজ উদ্দিনের ১৫টি সন্তানের মধ্যে ১০ ছেলে পাঁচ মেয়ে। বড় ছেলে ডাক্তার শেখ মহিউদ্দিন - আদ্-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক ও আকিজ বিড়ির চেয়ারম্যান, অন্য সন্তানদের মধ্যে শেখ মোমিন উদ্দিন - এসএএফ চামড়া ফ্যাক্টরির এমডি, শেখ আফিল উদ্দিন - আফিল গ্রুপের এমডি, শেখ বশির উদ্দিন - আকিজ গ্রুপের এমডি। এ ছাড়া শেখ নাসির উদ্দিন, শেখ আমিন উদ্দিন, জামিন উদ্দিন, শেখ আজিজ উদ্দিন, শেখ জামিল উদ্দিন সবাই আকিজ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত।
তার অবর্তমানেও দেখানো পথে এগিয়ে যাচ্ছে আকিজ গ্রুপ। তার মৃত্যুর পর আকিজ গ্রুপ আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি খুলেছে এবং ব্যবসা বড় থেকে বড় হয়ে চলেছে।
শেখ আকিজ উদ্দিন ছিলেন সততা, আত্মবিশ্বাস ও মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা। গভীরভাবে চিন্তা করে প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতেন ভেবেচিন্তে। যে কোনো পরিস্থিতিতেই সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহের ওপর ভরসা রাখতেন। সময় যত খারাপই আসুক, তিনি মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতেন। দেশের সবচেয়ে বড় একজন ধনী ব্যক্তি হয়েও তার মাঝে কোনোদিন অহংকারের প্রকাশ দেখা গেছে বলে শোনা যায়নি। পোশাক-আশাক এবং চাল-চলনে অত্যন্ত সাদাসিধে ভাবে চলতেন তিনি।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তিনি ১৯৮০ সালে আদ্ব-দীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি মানব সেবায় উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছে। এই ট্রাস্টের অধীনে আদ্ব-দীন শিশু কিশোর নিকেতন, আদ্ব-দীন নার্সিং ইনস্টিটিউট, আদ্ব-দীন ফোরকানিয়া প্রজেক্ট এর মতো মানবসেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা ও অসহায় মানুষকে সাহায্য করে চলেছে। আদ্ব-দীন ফাউন্ডেশন ও ট্রাস্ট ছাড়াও তিনি আকিজ কলেজিয়েট স্কুল ও সখিনা স্কুল ফর গার্লস প্রতিষ্ঠা করেন। নিজে শিক্ষিত হতে না পারলেও শিক্ষার প্রতি তার সব সময়ই দারুন অনুরাগ ছিল।
অনেক লোকই ভালো অবস্থায় এসে নিজের অতীত ভুলে যেতে চায় কিন্তু শেখ আকিজ উদ্দিন গর্বের সঙ্গে তার দারিদ্রময় অতীত, দরিদ্র বাবা-মা ও সংগ্রামের কথা বলতেন। তিনি কখনোই ভাবতেন না যে, এসব তাকে ছোট করবে। সাহসী ও বড় মনের মানুষ না হলে এটা করা যায় না। ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর ৭৭ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228