ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় বৃদ্ধির হারে দ্বিতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম

জাফর আহমদ
🕐 ৩:৪৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ১১, ২০২১

মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় বৃদ্ধির হারে দ্বিতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম

ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এক অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে। পুকুরের পানির মাছ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে শুধু এমনই নয়। সমুদ্রের কাছাকাছি উত্তাল নদীর ঢেউকে বশ মানিয়ে এই ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির মতো সাফল্য দেখিয়েছে দেশ। তারই ফলশ্রুতিতে ২০২০-২১ মৌসুমে ইলিশ উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। যা বিশ্বের মোট ইলিশ উৎপাদনের মধ্যে ৭০ ভাগ। এ সাফল্য দেশের মোট মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের তৃতীয় মিঠাপানির মাছ উৎপাদকারী দেশ।

বিভিন্ন নীতি উদ্যোগ কৌশলের ফলে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে দেশের এই সাফল্য; ফিরিয়ে আনা হয়েছে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ ২৩ প্রজাতির মাছ। গত এক দশকে ফিরে এসেছে এমন দেশি মাছের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। প্রাকৃতিক ও বাণিজ্যিক চাষ উভয়ভাবেই বাড়ছে মাছের উৎপাদন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিঠাপানির মাছের উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। সরকারি হিসাবে দেখা গেছে বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে। মাথা প্রতি ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন হচ্ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ২০২০’ নামে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাদু পানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বছরে ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশের মিঠা পানির মাছের উৎপাদন। এ হারে প্রথম স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ায় ১২ শতাংশ হারে উৎপাদন বাড়ছে মিঠাপানির মাছের।

গবেষকরা বলছেন, ‘প্রায় বিলুপ্ত’ অবস্থা থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে মাছের ফিরে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয়েছে হাওর এলাকা এবং মেঘনা নদীর অববাহিকায়।

ইলিশ গবেষকরা নৌ-সীমানার ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ’ কিলোমিটার ও পদ্মার অংশে ২০ কিলোমিটার নদীতে ৬০ ভাগ ইলিশের অস্তিত্ব পেয়েছেন। অভয়াশ্রম বাস্তবায়ন, জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম অর্থাৎ ইলিশ রক্ষার পদক্ষেপগুলো ক্রমেই জোরদার করা হচ্ছে। তাই ইলিশের উৎপাদন বাড়ছেই। দুই-এক বছরের মধ্যে যা সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের চেয়ে সাগর জলাশয়ে ইলিশের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে তথা নদীতে ইলিশের উৎপাদন কম হিসেবে বিবিধ কারণ রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, নদীতে অপরিকল্পিত ড্রেজিং, নদী দূষণ, চর, ডুবো চর, জাটকা নিধন, মা ইলিশ নিধন, নদীতে জুপ্লাংটন ও পাইটোপ্লাংটন উৎপাদনে ব্যত্যয়। এক্ষেত্রে নদীর যে স্বাভাবিক প্রবাহ তা ধরে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।

চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের তথ্য মতে, ৩৩ কোটি টাকা প্রকল্পের অধীনে চাঁদপুরে জেলেদের প্রশিক্ষণ এবং সচেতন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, অভয়াশ্রমগুলো সার্বিক পরিস্থিতি নির্ণয়, ইলিশ গবেষণা জোরদার ও ছোট ছোট ইলিশের পেটে ডিম আসার কারণ নিরুপণ, ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র পরিবর্তনের কারণ নির্ণয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর কাজ করা, ইলিশের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ ও মূল্য নির্ধারণ, ইলিশের ডিম ও রেণুর সঠিক পরিসংখ্যান নির্ণয় ও মজুদ, ইলিশ গবেষণাগারের পরিমার্জন ও সংস্করণসহ ইত্যাদি বিষয়ে চাঁদপুরের ‘ইলিশ উৎপাদন জোরদারকরণ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া নতুনভাবে ২৪৬ কোটি টাকার ‘ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ ২৯টি জেলার ১৩৪ উপজেলায় এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে।

২০০৬ সাল থেকে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে সারা দেশের অভয়াশ্রম এলাকায় ইলিশ ধরা, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ করে মৎস্য অধিদফতর। এ কারণে প্রচুর জেলে বেকার হয়ে পড়েন। জাটকা রক্ষার মৌসুমে জেলেদের জন্য ৪০ কেজি করে ভিজিএফ-এর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া জেলেদের সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণাসহ মতবিনিময় সভাও করে মৎস্য অধিদফতর। অবশ্য মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষা কর্মসূচি চলাকালীন সময়ে কর্মক্ষম মানুষ অবসর থাকায় আঞ্চলিক ও জাতীয় জিডিপিতে এর প্রভাব পড়ে বলে জানায় অর্থনীতিবিদরা।

ব্যবসায়ীরা বলছে ইলিশ উৎপাদন বাড়লেও নদ-নদীতে ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য কেউ বলছেন চর-ডুবোচরসহ নদী দূষণের কারণে নদী মাছ আসতে চায় না। অথবা তারা পরিভ্রমণ করতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। মাছ উৎপাদনেও এর প্রভাব পড়ছে। ইলিশ মাছ সাগরের কাছাকাছি থেকে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। খোলা কাগজের চাঁদপুর প্রতিনিধি কাদের পলাশের অনুসন্ধানে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন, আমরা যে ইলিশকে চাঁদপুরের ইলিশ বলে জানি আসলে তার পুরোটাই চাঁদপুরের নয়। তার অধিকাংশই দক্ষিণাঞ্চলের মাছ। অবশ্য মেঘনারই। আর সাগর থেকে চাঁদপুর ঘাটে ইলিশের আমদানি হয়। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের তরফ থেকে যে সকল উদ্যোগ নেওয়া হয় তা শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। যদি সম্ভব হতো তবে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়তে পারত। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষা কার্যক্রম সফল হওয়ায় গত ৬ বছর ইলিশের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে। শুধুমাত্র চাঁদপুর অঞ্চলেই ২০১৬-১৭ মৌসুমে ২৮ হাজার ১৬ মেট্রিক টন যা ২০১৭-১৮ মৌসুমে বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ হাজার ১৩৩ মেট্রিক টন এবং ২০১৮-১৯ মৌসুমে তা প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ছাড়িয়েছে। শুধু তাই নয় সারা দেশেই ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ মৌসুমে দেশের ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২১১ মেট্রিক টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৯৬ মেট্রিক টন আর সামুদ্রিক জলাশয়ে ২ লাখ ৫১ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। বছরভিত্তিক ইলিশের উৎপাদনের হিসাব দেখলে জানা যায়, ২০১৫-১৬ মৌসুমে দেশের ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৯৫১ মেট্রিক টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৬ মেট্রিক টন আর সামুদ্রিক জলাশয়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার ১৯৫ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। ২০১৬-১৭ মৌসুমে দেশের ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ২ লাখ ১৭ হাজার ৪৬৯ মেট্রিক টন আর সামুদ্রিক জলাশয়ে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৯৪৮ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। ২০১৭-১৮ মৌসুমে দেশের ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ মেট্রিক টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ২ লাখ ৩২ হাজার ৬৯৮ মেট্রিক টন আর সামুদ্রিক জলাশয়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। ২০১৮-১৯ মৌসুমে দেশের ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ মেট্রিক টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৭৯ মেট্রিক টন আর সামুদ্রিক জলাশয়ে ২ লাখ ৯০ হাজার ৩১৯ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়।

চলতি ২০২১ সালের জাটকা রক্ষা কার্যক্রম শেষে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, চলতি বছর নতুন করে প্রায় ৩৭ হাজার ৮ শতাধিক কোটি জাটকা ইলিশ জনতায় যুক্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে চলতি বছর জাটকা রক্ষা কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর দেখা গেছে কিশোরী ইলিশে ডিম। যদিও তুলনামূলক ছোট আকারের ইলিশের পেটে ডিম আসা উদ্বিগ্নের কারণ হলেও ইলিশ গবেষকরা বলছে বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়।

মিঠাপানির মাছ উৎপাদন ও সংরক্ষণে হাওরাঞ্চল বড় ধরনের অবদান রাখছে। দেশের পূর্বাঞ্চলের ৭ জেলায় বিস্তৃত হাওরে দেশি জাতের মাছ চাষ হচ্ছে। এ অঞ্চলেকে মাছের গোডাউন বলা হয়। আর এই গোডাউন সংযত ও সংরক্ষণে সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর ফলে এখানে মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় মাছও ফিরে আসছে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper