খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিস্ময়
জাফর আহমদ
🕐 ২:০৭ অপরাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২১
বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার কোটি মেট্রিক টন দানাদার খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধানত চাল, ডাল, গম, ভুট্টা। এর বাইরেও বিভিন্ন রকম দানাদার খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। শাকসবজি, ফলফলাদি, মাছ ও মংস্য উৎপাদেনও বাংলাদেশ বড় ধরনের সফলতা দেখাতে পেরেছে। ১৯৭২ সালের শুরুতে উৎপাদনের এ পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ মেট্রিক টন। বাজার ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে খাদ্যের দাম মাঝে মাঝে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেও দেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগানের পাশাপাশি প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাদ্য বাংলাদেশেই উৎপাদন হচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষিতে এক বিপ্লব সাধিত হয়েছে।
বাংলাদেশের মাটি উর্বতায় অনন্য। কৃষিতে সরকারের সর্বোচ্চ মনোযোগ এবং বিনিয়োগের কারণে এক-ফসলি জমিতেও সারা দেশে আবাদ হয়েছে গড়ে দুটি ফসল। এলাকাভেদে এ চাষাবাদ গড়িয়েছে তিন থেকে চার ফসলেও। এতে বিশ্বের গড় উৎপাদন হারকে পেছনে ফেলে জনসংখ্যার হিসাবে নবম স্থানে থাকা বাংলাদেশ খাদ্যে হয়ে উঠেছে স্বনির্ভর। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে মেনে নিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় থেকে চতুর্থ অবস্থানে ওঠানামা করছে। স্বাধীনতার আগে অধিকাংশ জমি চাষাবাদে ফসল কম পাওয়া যত। এতে তখনকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠেরই তিন বেলা দুই মুঠো খাবার জোটানো কষ্টকর হতো।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ মতে, বিশ্বজুড়ে প্রতি হেক্টরে শস্যের গড় উৎপাদন হার যেখানে প্রায় তিন টন, সেখানে বাংলাদেশে তা সোয়া চার টনে উন্নিত হয়েছে। ৫০ বছরে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। গমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। গত ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে প্রায় সোয়া ৪ কোটি টন। আগের বছর ২০১৯ সালে উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টন খাদ্যশস্য।
শিক্ষা থেকে খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব
১৯৭৪ সালে খাদ্যের অভাবে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হওয়া, ২০০৭ সালে খাদ্য কম উৎপাদন হওয়ায় টাকা দিয়েও বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে না পারায় বর্তমান সরকার খাদ্য উৎপাদনে বিশেষ মনোনিবেশ করে। ২০০৯ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেই খাদ্য উৎপাদন ও গবেষণায় বিশেষ মনোযোগ দেয়। সাথে সাথে সার, বীজ, যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ভর্তুকিসহ নগদ সহায়তা দেওয়া শুরু করে। যাতে খাদ্য উৎপাদনে কোন সমস্যা তৈরি না হয়। যাতে খাদ্য সমস্যাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সংকট তৈরি না হয়। ২০১৭ সালে হাওর ও উত্তরাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলে ও আগাম বন্যার কারণে বাংলাদেশে খাদ্য কিছু কম উৎপাদন হয়। বিশেষ করে মার্চ এপ্রিল মাসে ধান উঠায় হাওরাঞ্চল বছরব্যাপী খাদ্য সরবরাহ সুষম রাখতে সহায়তা করে।
ওই সময় পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যাতে ধান নষ্ট হলে সরকার বিপাকে পড়ে। এরপর থেকে ধান উৎপাদনই শুধু নয় বা বছরের বিশেষ সময়কেই শুধু গুরুত্ব দেওয়া নয়। পুরো বছর এবং উৎপাদিত ধান সময় মতো কৃষকের ঘরে তুলতেও বিশেষ মনোযোগ দেয়। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে কৃষি মজুর প্রেরণ থেকে শুরু করে ভর্তুকি মূল্যে ফসল কাটা-মাড়ায়ের যন্ত্রও সরবরাহ শুরু করে। হঠাৎ করে পানি প্রবেশ করে ধান নষ্ট রোধে বাঁধসড়ক ও পানি ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দেয়। যার সুফল পাচ্ছে।
নানামুখী উদ্যোগ
কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, বর্তমান সরকারের কৃষিতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা, উন্নত প্রযুক্তি, বীজ ও সারের ব্যবহার, কৃষিবিজ্ঞানীদের উচ্চফলনশীল নতুন জাত উদ্ভাবন বাংলাদেশের এই অর্জনের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে। তবে কৃষকের কাছে তথ্য পল্লী অঞ্চলে অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে ব্যাংক এবং আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পল্লীকে লক্ষ্য করে শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
২০০৯ সালে যার পরিমাণ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের দুই শতাংশ কৃষকের মাঝে বিতরণ করছে। এর বাইরে কৃষি ও রাজশাহী উন্নয়ন ব্যাংক কৃষির জন্যই বিশেষায়িত হয়েছে। এর বাইরে আরও প্রায় ২০ হাজার টাকা যাচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণী সংস্থার মাধ্যমে। এ বিপুল ইনপুট খাদ্য উৎপাদনে অসামান্য ভূমিকা রাখছে।
করোনাতে খাদ্য সংকট হয়নি
খাদ্য উৎপাদনে শক্ত অবস্থান থাকার কারণে বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে খাদ্য সংকট তৈরি হয়নি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা যেখানে করোনার কারণে বিশ^জুড়ে খাদ্য উৎপাদন হ্রাসের আশঙ্কা করেছিল। বাংলাদেশে যেখানে খাদ্য উৎপাদনের শক্ত অবকাঠামো থাকার কারণে খাদ্য উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে সমস্যা হয়নি।
সরকার থেকে শুধু খাদ্য উৎপাদনের অব্যাহত ধারা চালু রাখতে প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রচারে মনোযোগ দিয়েছিল। এতে ভয়াবহ করোনার মধ্যেও অন্য সব সমস্যা হলেও খাদ্যের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিকতা থাকছে না
খাদ্য উৎপাদনে বড় ধরনের সফলতা এলেও ধারাবাহিকভাবে খাদ্য উৎপাদন বাড়েনি। প্রকৃতির খেয়াল খুশিতে খাদ্য উৎপাদনের ছন্দ পতন হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তীর সার্বিক কৃষি খাতের শস্য উপখাতের প্রধান ফসল প্রধান খাদ্য চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মূল সমস্যা হলো, চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হারে ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না।
গত এক দশকে দেশে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হারের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলেই এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও অন্যান্য রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৩৫ লাখ ৪১ হাজার টন।
২০১১-১২ অর্থবছরে চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার টন। অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ১ দশমিক ০৪ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার টন; যার অর্থ, এ বছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টনে পৌঁছায়। ফলে এ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টনে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ০৩ শতাংশ।
২০১৫-১৬ অর্থবছরেও চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ টন। অর্থাৎ এ বছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টন। এ অর্থবছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল অতি উৎসাহব্যঞ্জক। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৬৭ লাখ টনে। যে সব কারণে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হারে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যাচ্ছে না তা হলো-এক. দেশে চালের উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতিনির্ভর। ২০১৭ সালের এপ্রিলে হাওরাঞ্চলে আগাম বন্যায় সরকারি হিসাবে ১০ লাখ টন বোরো ফসল নষ্ট হয়। দেশে চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আমন ফসলটির উৎপাদন প্রলয়ংকরী বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নজিরের অভাব নেই।
বাজার ব্যবস্থাপনায় ত্রুটিতে অর্জন ম্লান হচ্ছে
খাদ্য উৎপাদনে সাফল্য এলেও বাজার ব্যবস্থাপনা ত্রুটি রয়েছে। এ কারণে একদিকে কৃষক যেমন সঠিক দাম পাচ্ছে না। আবার ভোক্তা পর্যায়ে বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে। গত ১০ বছরে খাদ্য উৎপাদনে যেমন সাফল্য এসেছে তেমনি দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। মজুদদারি, ফটকাবাজ, সিন্ডিকেটকারীরা খাদ্য উৎপাদনের সাফল্য পুরোটাই ঘরে তুলে। সরকার বাজার থেকে চাল ক্রয় করা, চাল আমদানি ও কম আয়ের মানুষকে ন্যায্যমূল্যে চাল বিতরণের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। হ
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228