ময়মনসিংহে মাছ চাষ
অতিরিক্ত পৌনে তিন লাখ টন উৎপাদন
রাকিবুল হাসান রুবেল
🕐 ১:১৯ অপরাহ্ণ, জুন ২০, ২০২১
গত দেড় দশকে ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে ওঠা মৎস্য খামারে মাছ চাষ করে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধন হয়েছে। এ সময়ে ময়মনসিংহে মাছ চাষে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। ছয় বছর ধরে মাছ উৎপাদনে সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থান ধরে রেখেছে জেলাটি। বর্তমানে জেলায় ৪ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। তা দিয়ে জেলার চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত হয় ২ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। যা সারা দেশের বিভিন্ন জেলাতে চলে যাচ্ছে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলায় প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার মাছ চাষি রয়েছেন। নিবন্ধিত হ্যাচারি রয়েছে ৩১৭টি। হ্যাচারিগুলোতে প্রতি বছর ১ লাখ ৮০ হাজার কেজি রেণু পোনা উৎপাদন হয়। আর মাছ উৎপাদন হয় প্রায় ৪ লাখ মেট্রিক টন। জেলার ৫৩ লাখ জনগোষ্ঠির মাছের চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। ফলে বছরে উদ্বৃত্ত হয় ২ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। এসব উদ্বৃত্ত মাছ চলে যেত দেশের বিভিন্ন জেলাগুলোতে। কিন্তু গত বছর দেড়েক ধরে করোনার কারণে উদ্বৃত্ত মাছ সময়মতো বিক্রি না হওয়ায় লোকসানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে চাষিদের। জেলা মৎস্য অফিসের হিসেবেই জেলায় করোনাকালীন সময়ে ৫৮ হাজার ৪৬৭ জন মৎস্যচাষি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। গত ২০১৯-২০ অর্থ বছরের হিসেবে করোনাকালীন সময়ে ক্ষতির পরিমাণ ৩৩৫ কোটি ২ লাখ টাকার উপরে। ফলে করোনাকালীন সময়ে জেলার প্রায় ৬০ হাজার মৎস্যচাষির ৩৩৫ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।
ময়মনসিংহ সদরের ব্রহ্মপুত্র ফিস অ্যান্ড হ্যাচারীর স্বত্বাধিকারী মো. নূরুল হক জানান, গত এক দেড় বছরে করোনাকালীন সময়ে যারা ঝুঁকি নিয়ে রেণু উৎপাদন করেছে তাদের প্রায় সবাই লোকসানে পড়েছে। সিলেট, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় এ অঞ্চলের রেণু পোনার একটি বিশাল চাহিদা ছিল। বর্তমানে এসব অঞ্চলে ৩০ ভাগেরও বেশি চাহিদা কমে গেছে। ফলে পুকুরেই বড় হচ্ছে রেণু পোনা। বর্তমানে চাহিদা না থাকায় রেণু পোনা ও পোনামাছ কোনোটাই বিক্রি করতে পারছেন না হ্যাচারী মালিকরা। ক্রেতার অভাবে উৎপাদন কমে অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। চলতি মৌসুমে লোকসানের আশঙ্কায় অনেক হ্যাচারী মালিক রেণু উৎপাদনে আসেনি।
ময়মনসিংহ সদরের রেণু পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারী মালিক এখলাস উদ্দিন জানান, করোনার আগে দেশের বিভিন্ন জেলায় আমরা রেণু পোনা সরবরাহ করতাম। বছরে ৪/৫ কোটি পোনা উৎপাদন ও বিক্রি করা হতো। বর্তমানে তা অর্ধেকেরও কম রেণু উৎপাদন করেও পোনা বিক্রির ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। মৌসুম চলে যাচ্ছে অথচ এখনো অর্ধেক পোনা বিক্রি হয়নি।
ঈশ্বরগঞ্জের খান মৎস্য খামারের মালিক সুজন খান জানান, করোনার আগে শিং, মাগুর, পাবদা ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা মণে বেচাকেনা হতো। বর্তমান বাজারে ৬/৭ হাজার টাকায় ক্রেতা পাওয়া যায় না। করোনাকালীন গত দেড় বছরে লোকসানের কারণে তার মতো অনেকেই পুঁজি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে মাছের উৎপাদন খরচের মিল নেই।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মাঝিহাটি গ্রামের এমএ রায়হান রায়হান জানান, করোনার আগে ৩২ শতাংশের একটি পুকুরে শিং মাছ চাষ করে প্রায় ৯ হাজার কেজি মাছ উৎপাদন করেছি। বাজার দর ভালো থাকায় সেই সময় লাভও হয়েছিল ভালো। বর্তমান করোনাকালীন সময়ে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং মাছের দাম কমে যাওয়ায় মাছ চাষ করে উৎপাদন খরচ ওঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
করোনা মহামারীর কারণে সারা দেশে প্রভাব পড়েছে। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ, বিপণন ও ভোগ। এর আঘাত মাছ চাষেও লেগেছে। সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায়, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও মাছের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় চাষিরা আর্থিক লোকসানে পড়েছে। গত দেড় বছরে হ্যাচারিতে রেণু পোনা এবং খামারে মাছের উৎপাদন দিন দিনই হ্রাস পাচ্ছে। গণপরিবহন ও রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক না হওয়ায় চাষিদের উৎপাদিত রেণু পোনা ও চাষ করা উদ্বৃত্ত মাছ জেলার বাইরে সরবরাহ করতে পারছে না। মাছ চাষিদের দাবি গত দেড় বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন কমে নেমে গেছে অর্ধেকে। যদিও মৎস্য অধিদপ্তর এমন অভিযোগ মানতে রাজি নন। তারা বলছেন করোনার সময়ে মাছের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে সবধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ফিস হ্যাচারি অ্যান্ড ফার্ম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এম এ বাতেন জানান, সরকারি হিসেবে জেলায় ১ লাখ ১২ হাজার মাছ চাষির কথা বলা হলেও বাস্তবে সেই চাষির সংখ্যা অনেক বেশি। সরকার নিবন্ধিত হ্যাচারি রয়েছে ৩১৭টির কথা বলা হলেও বাস্তবে এর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। ময়মনসিংহ অঞ্চলে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন হয় তা দিয়ে এ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন নগর ও জেলা শহরে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকায় শহরের অনেক মানুষ গ্রামে চলে যাওয়ায় রাজধানীসহ শহর, বন্দর ও নগরীতে মাছের চাহিদা কমে গেছে। মাছের বেচাকেনা কমে যাওয়ায় পোনার চাহিদা কমে গেছে। ফলে কোটি টাকার মাছ এখনও অবিক্রীত রয়ে গেছে। এই অবস্থায় অনেক হ্যাচারী বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু হ্যাচারী ও খামার তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার যদি স্বল্প সুদে অথবা প্রনোদনা আকারে হ্যাচারী মালিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে তাহলে হ্যাচারী ও মাছের ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। অন্যথায় হ্যাচারী ও মাছের ব্যবসায় যে ধস নেমেছে তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই’র) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আরও জানান, সারা দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ইনস্টিটিউট কর্তৃক মৎস্যচাষিদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার মে. টন। গত ১২ বছরে পুকুরে দেশীয় মাছের উৎপাদন প্রায় চার গুণ বেড়ে আড়াই লাখ মে. টন হয়েছে।
তাছাড়াও বিলুপ্তপ্রায় মাছ পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে কাজ করছে বিজ্ঞানীরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে স্বাদুপানির ২৬০টি মাছের মধ্যে ৬৪টি প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। এর মধ্যে ৯টি অতিবিপন্ন, ৩০টি বিপন্ন এবং ২৫টি বিপন্নের পথে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে ২৭টি বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন সক্ষম হয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা জানান, চলমান কোভিড-১৯ এর প্রভাবে জেলায় মাছের উৎপাদনে কোনো ঘাটতি হয়নি। বরং প্রতি বছর জেলার চাহিদা পূরণ করে আরও ২ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত হয়। গত দেড় বছরে করোনার কারণে জেলার ৫৮ হাজার ৪৬৭ জন মৎস্যচাষি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের নামের তালিকা মোবাইল নম্বরসহ মৎস্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228