ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গ্রামীণ অর্থনীতিতে মন্দাভাব কাটাতে অবদান ক্ষুদ্রঋণের

রনি সরকার
🕐 ১২:৪৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৪, ২০২১

গ্রামীণ অর্থনীতিতে মন্দাভাব কাটাতে অবদান ক্ষুদ্রঋণের

করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ধাবিত করেছে। মরণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে গোটা বিশ্ব এখনো স্থবির। ছোঁয়াচে এ ভাইরাস এ পর্যন্ত প্রায় ২১১টি দেশে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটিয়েছে। সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশেও এ ভাইরাসের ছোবলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যাও। করোনাভাইরাস মহামারী শুধু মৃত্যুই ডেকে আনছে না, বরং এটি দেশের অর্থনীতির চাকাকেও বন্ধ করে দিয়েছে। স্থবির করে দিয়েছে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য, জনজীবন ও উৎপাদনের প্রায় সমস্ত প্রক্রিয়াও। তাই গ্রামীণ অর্থনীতি এখন সংকটের মধ্যে আছে।

বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস দিয়েছে। দেশে গত বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ শতাংশ। প্রত্যাশা করা হয়েছিল, এ ধারা অব্যাহত থাকবে, কিন্তু অদৃশ্য এই করোনাভাইরাসের প্রকোপে এ হার অনেকটা সংকুচিত হয়ে আসবে।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি ) বলেছে, করোনার প্রকোপে বাংলাদেশের জিডিপির শূন্য দশমিক ২ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষতি হতে পারে। সেই সঙ্গে এডিবি আরও বলেছে, বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির কারণে ১৪ থেকে ৩৯ লাখ মানুষ বেকার/ কর্মহীন হতে পারে। আইএমএফ বলেছে, ২০২০ সালে প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশে নেমে আসবে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এছাড়া, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খাতের পণ্যের চাহিদাও কমবে, যা দেশীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ঝুঁকি তৈরি করবে। এতে করে পল্লী এলাকায় গরিবের সংখ্যাও বাড়বে। এরূপ অবস্থায় করোনাভাইরাসেরর ঝুঁকি কমানো এবং আর্থিক খাতের স্থবিরতা দূরীকরণে অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি নেওয়ার সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক সহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিশ্বের বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করতে সরকারের উচিত একটি রোডম্যাপ আঁকা। সেক্ষেত্রে প্রথমেই নজরদারি জোরদার করতে হবে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার ওপর। অর্থনীতিতে যে খাতটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে তা হলো এনজিও এবং এমএফআইয়ের ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা। দেশব্যাপী প্রায় শতাধিক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র নিরসনের লক্ষে প্রায় ৩ কোটি দরিদ্র, হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষকে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করেছে।

এ ক্ষুদ্রঋণপ্রাপ্ত পরিবারগুলো উৎপাদন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম যেমন, হাঁস-মুরগি পালন, ডেইরি ফার্ম ও টার্কি পালন ইত্যাদি ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করে নিজেরাও যেমন স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিসহ জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্ববহ ভূমিকা পালন করছে। ফলে, যেসব পরিবার দরিদ্র ও হতদরিদ্র ছিল তাদের এক বিশাল অংশেরই দারিদ্র নিরসন হয়েছে। মানুষ নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি অন্যদেরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে।

এখানে আরও লক্ষণীয়, বাংলাদেশে সাধারণত মঙ্গা দেখা দেয় আশ্বিন ও কার্তিক মাসে। এ সময় গ্রামগঞ্জে গো-খাদ্যের অভাবসহ মানুষের নানাবিধ সমস্যা প্রতিলক্ষিত হয়। মানুষরা ভিক্ষাবৃত্তি সহ বহু অপ্রীতিকর কাজে লিপ্ত হয়। যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে এইসব এনজিও যেমন, ব্র্যাক, আরডিআরএস ও গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে। এভাবেই দেশজ উৎপাদন ও দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়ায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ব্র্যাকসহ বেশ কিছু এনজিও মানুষের মধ্যে বিশেষ করে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করত, স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, নারীদের আত্মকর্মসংস্থান ও নারী-পুরুষ বৈষম্য অবসানের আশ্বাস ইত্যাদিই ছিল এসব এনজিওদের প্রধান লক্ষ্য। পরে আশির দশকের দিকে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিওগুলো ক্ষুদ্রঋণের সূচনা করে। এতে করে, ব্যাংকের ঋণবঞ্চিত বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে নারীরা ব্র্যাক, আশা ও ব্যুরো বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে ক্ষুদ্রঋণ নেওয়ার সুযোগ পায়। এই ঋণ নিয়ে তারা হাঁস-মুরগি পালন, গবাদিপশু পালন, মৎস চাষ ও সবজি উৎপাদন করে শুধু নিজেরাই স্বাবলম্বী হননি বরং দেশের জাতীয় উৎপাদনেও নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তিকে যুক্ত করেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, দেশের সব মানুষের বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ে হাতের কাছে ব্যাংক না থাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ কম। দশ টাকায় খোলা হিসাবগুলো লেনদেনের অভাবে প্রায়ই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ৫০ শতাংশের ব্যাংক হিসাব আছে। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে এ হার ২৫ শতাংশের কম। নারীদের ক্ষেত্রে আরও কম। ২১ দশমিক ২ শতাংশ জনগণ মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। ৯ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় রয়েছে এবং ঋণ রয়েছে ৯ দশমিক ০১ শতাংশ ব্যক্তির। ব্যাংকগুলোর গ্রাম পর্যায়ে নেটওয়ার্ক না থাকায় দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী ব্যাংকে সঞ্চয় ও ঋণ থেকে বঞ্চিত। সেক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থাগুলো অবিস্মরণীয় অবদান রেখেই চলছে। এটি সত্য যে, এমএফআই খাতের দেড় লাখ কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণে প্রায় ৩ কোটি মানুষ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে। তারা নিজেদের পরিবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছে।

নিজেরা সামাজিকভাবে মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতা তাদের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এসবই সম্ভবপর হয়ে উঠেছে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশ পুনর্গঠনে প্রতিষ্ঠিত স্যার ফজলে হাসান আবেদের বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান “ব্র্যাক” যে সার্বিক উন্নয়ন কর্মকা-ের সূচনা ঘটিয়েছিল, সেই ধারাকে আজ অবধি অব্যাহত রেখেছে এনজিও এবং এমএফআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। যার ফলে, বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের স্বর্ণসোপান সিঁড়িতে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। সেইসঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিও মন্দাভাব দৃঢ়ভাবে কাটাতে পেরেছে।

রনি সরকার : শিক্ষার্থী
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper