কৃষিতে নারী
শাশ্বতী সরকার
🕐 ১২:৪৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ০৪, ২০২১
কৃষি মানবসমাজের আদিমতম পেশা। বর্তমান সময়েও কৃষির গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা অনেকেই মনে করি কৃষি কাজের সঙ্গে কেবল পুরুষরাই জড়িত, নারীর অংশগ্রহণ হয়তো কৃষিতে খুব একটা নেই। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানিনা আদিম যুগে কৃষিকাজ শুরু হয়েছিল নারীর হাতেই। সেই সময়ে পুরুষরা যখন পশু শিকারে বনে-জঙ্গলে চলে যেতেন তখন নারীরা ব্যস্ত থাকতেন গৃহস্থালির কাজে। বাড়িতে থাকা অবস্থায় নিজ হাতে বীজ বপনের মাধ্যমে নারীরা কৃষিকাজের প্রচলন শুরু করে। মাটিতে ফেলে দেওয়া বীজ থেকে পরবর্তীতে চারা গজাতে দেখে আনন্দিত হয়ে উঠতেন তারা। এই বীজ থেকে চারা তৈরির মাধ্যমেই কৃষির সূচনা। সেই আদিমকাল থেকেই কৃষির সঙ্গে যুক্ত আছেন নারীরা। বর্তমান সময়েও এর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বরং কৃষিতে নারীর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে কৃষিতেও তেমনি নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। অনেকেই মনে করতে পারে নারীরা কৃষিকাজ কীভাবে করবে কিন্তু চাষের জন্য জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা ও বাজারজাতকরণের পূর্ব পর্যন্ত কৃষি খাতের ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭টি কাজে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। দেশের সর্বশেষ শ্রমজরিপ অনুযায়ী ২০১০ সালে দেশে কৃষিকাজে নিয়োজিত ২ কোটি ৫৬ লাখ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ ছিলেন নারী। এক দশকের ব্যবধানে কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন ৬৭ লাখ নারী। গত ১০ বছরে নারীর অংশগ্রহণ ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে ৭২.৬০ শতাংশ। দেশে মোট ৯০ লাখ ১১ হাজারের বেশি নারী সরাসরি কৃষিখাতে শ্রম দিচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিতে পুরুষের অংশগ্রহণ সাড়ে ৩ শতাংশ কমেছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে যাওয়া, অন্য পেশায় যাওয়া, শহরমুখী হওয়া এসবকে কারণ হিসেবে দেখা হয় কৃষিতে পুরুষ বিমুখতার।
কৃষির মোটামুটি সব ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা রয়েছে। ফসলের প্রাক বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমন কি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারী এককভাবেই করে। প্রায় এক কোটি নারী কৃষিকাজ, মৎস্যচাষ ও সামাজিক বনায়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো কৃষিকাজে জড়িত এ বিপুল নারী শ্রমিকের তেমন কোনো মূল্যায়ন করা হয় না।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীর এ বিপুল উপস্থিতির কোনো স্বীকৃতি নেই। ২৯ শতাংশ নারী অবৈতনিক পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকার পরও শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে অদৃশ্যই রয়ে আছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ নারী গৃহসহ কৃষিকর্মে সরাসরি অবদান রাখছেন। কিন্তু তাদের শ্রমকে শ্রমশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষিকাজ করলেও এই খাতে নারী শ্রমিকের বৈধ পরিচিতি নেই। কারণ তাদের এ কাজের জন্য তারা কোনো পারিশ্রমিক পায় না। তাদের এই কাজকে পারিবারিক কাজের মধ্যেই ধরা হয়। বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে কৃষিকাজকে নারীর প্রাত্যহিক কাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেখানে মজুরি প্রদানের তো প্রশ্নই আসে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেওয়া হয়। কাজে নারী-পুরুষের সমান মজুরি দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি মানা হয় না। সর্বশেষ কৃষি মজুরিবিষয়ক জরিপ অনুযায়ী, কৃষি মজুরি হিসাবে পুরুষ ১০০ টাকা পেলে নারী সেখানে পান ৭৫ টাকা। আবার কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃহৎ হলেও ভূমির মালিকানায় নেই নারীরা। ভূমিতে গ্রামীণ নারীর মালিকানা মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ এবং বাকি ৯৬ শতাংশ জমির ব্যক্তি মালিকানা রয়েছে পুরুষের নামে। নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-এর ১১ নং দফায় বলা হয়েছে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী শতকরা ৪০ ভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নারী। বাংলাদেশের খাসজমি ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন নীতিমালায় স্বামী-স্ত্রীর যৌথ মালিকানার বিধান থাকলেও নানাক্ষেত্রে তা নারীর অবস্থান রয়েছে একেবারে নিচের দিকে। বর্তমান সরকার অবশ্য নারী কৃষকদের উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে সরাসরি নারী কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। ‘কৃষাণী’ হিসেবে ১২ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪৭ জন নারী এ কার্ড পাচ্ছেন। সরকারের দেওয়া এই সুবিধাগুলো নারী কৃষককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনেক সাহায্য করবে। কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কৃষিকাজে নারীদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে নারীরা আরও আগ্রহী হবে। এর ফলে কৃষিখাতের উৎপাদন বাড়বে, জিডিপিতে কৃষির অবদানও বাড়বে।
শাশ্বতী সরকার : শিক্ষার্থী সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228